স্টাফ রিপোর্টার : ছোট-বড় নানা বিষয় খুব ক্ষণে ক্ষণে ভুলে যাওয়া সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ সঞ্জীব রায়কে একজন মানসিক চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান তার স্ত্রী কল্পনা রায়। কিন্তু চিকিৎসকের ওষুধ সেবনের পর ওই বৃদ্ধের মানসিক অবস্থার আরও অবনতি হয়। ওষুধ সেবনের পর দুই দিন অচেতন হয়ে পড়ে রইলেন সঞ্জীব রায়। যখন তার চেতনা ফিরে এলো তখন তিনি আগের থেকে বেশি খারাপ আচরণ শুরু করলেন। এমন ঘটনা ঘটেছে রাজশাহী নগরীতে। নামের পাশে পাঁচটি ভুয়া ডিগ্রি ব্যবহার করে দীর্ঘদিন ধরে মানসিক রোগের চিকিৎসা করে আসছিলেন। সত্তরোর্ধ্ব ওই বৃদ্ধের চিকিৎসা করতে গিয়ে বিপাকে পড়েন নিজেকে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ দাবি করা ওই চিকিৎসক।
রোগীর স্বজনেরা ওই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে ক্ষতিপূরণ মামলা করেন। আদালতেও ঠুকেন মামলা। রাজশাহী মহানগরীর পদ্মা আবাসিক এলাকায় থাকেন চিকিৎসক মোয়াজ্জেম হোসেন ওরফে বাবু (৫০)। রোগী দেখতেন শহরের আলুপট্টি এলাকার একটি ক্লিনিকে। এখন তিনি পলাতক। ভুক্তভোগী বৃদ্ধ সঞ্জীব রায়ের (৭৫) বাড়ি শহরের রানিবাজারে। তাঁর ভুলে যাওয়ার সমস্যা আছে। এ নিয়ে তাঁর স্ত্রী কল্পনা রায় প্রায়ই ঝামেলায় পড়তেন। আত্মীয়দের পরামর্শে স্বামীকে নিয়ে ‘মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ’ মোয়াজ্জেম হোসেনের কাছে গিয়েছিলেন। কিন্তু মোয়াজ্জেমের ওষুধ খাওয়ার পর তাঁর স্বামীর দুদিন কোনো জ্ঞান ছিল না বলে জানালেন কল্পনা রায়।
তিনি বলেন, যখন তাঁর স্বামী চেতনা ফিরে পেলেন, তখন তিনি ‘বদ্ধ উন্মাদের’ মতো আচরণ করতে লাগলেন। পরে আবার মোয়াজ্জেমের কাছে গেলে সঞ্জীবকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করার পরামর্শ দেন। কিন্তু তাঁকে মানসিক হাসপাতালে না নিয়ে শহরের অন্য এক চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন, মোয়াজ্জেমের ব্যবস্থাপত্রের মধ্যে তিন ধরনের ঘুমের বড়ি ছিল। চিকিৎসাটা সম্পূর্ণ ভুল ছিল। পরের চিকিৎসকের ওষুধ সেবন করে তাঁর স্বামী অনেকটা সুস্থ হন।
এ ঘটনায় সঞ্জীবের স্ত্রী বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের রাজশাহী জেলা শাখার সভাপতি কল্পনা রায় বাদী হয়ে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি চিকিৎসা অবহেলার অভিযোগে রাজশাহীর চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন।
এর আগে তিনি জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে ক্ষতিপূরণ মামলা করেন। আদালতে মামলা করার পর পুলিশ ব্যুরো অব ইভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) মামলা তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়। গত ৭ অক্টোবর পিবিআইয়ের উপপরিদর্শক দেলোয়ার হোসেন আদালতে ওই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। দেলোয়ার হোসেন বলেন, এমবিবিএস ডিগ্রি ছাড়া মোয়াজ্জেমের নামের পাশে লেখা কোনো ডিগ্রির বিপরীতে কোনো সনদ পাওয়া যায়নি। তদন্ত শেষে তাঁর বিরুদ্ধে রোগীর সঙ্গে প্রতারণা ও চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ আনা হয়েছে। তদন্ত সূত্রে জানা যায়, মোয়াজ্জেম রাজশাহীর একটি বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক।
তাঁর নামের পাশে এমবিবিএস ডিগ্রি ছাড়াও ইউএসএমএলই (আমেরিকা), এমডি (সাইকিয়াক) আমেরিকা, পিজিটি (সাইকিয়াট্টি নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি ইউএসএস), মানসিক, মাদকাসক্ত, এবং সাইকো-সেক্স (যৌন) থেরাপিস্ট, মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ও কাউন্সেলর লেখা আছে। এসব ডিগ্রির কোনো সনদ পাওয়া যায়নি। চিকিৎসক হিসেবে তাঁর নিবন্ধন নম্বর এ-৪০০৫৮। পদ্মা আবাসিক এলাকায় বাড়িতে পাওয়া যায়নি মোয়াজ্জেম হোসেনকে। তাঁর ব্যবহৃত ফোন নম্বরটিও বন্ধ। তাঁর বাবা আলী আকবর বললেন, বছর দুই ধরে ছেলের সঙ্গে তাঁদের কোনো যোগাযোগ নেই। তিনি কোথায় থাকেন, তাঁরা কিছু জানেন না। ছেলের নামের পাশের ডিগ্রি সম্পর্কেও তিনি কিছু জানেন না।
মোয়াজ্জেম হোসেনের নামের পাশে এমবিবিএস ডিগ্রি ছাড়াও ইউএসএমএলই (আমেরিকা), এমডি (সাইকিয়াক) আমেরিকা, পিজিটি (সাইকিয়াট্টি নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি ইউএসএস), মানসিক, মাদকাসক্ত, এবং সাইকো-সেক্স (যৌন) থেরাপিস্ট, মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ও কাউন্সেলর লেখা আছে। এসব ডিগ্রির কোনো সনদ পাওয়া যায়নি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই চিকিৎসক রাজশাহীর বারিন্দ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ছিলেন। ওই হাসপাতালের পরিচালক সুজিত ভদ্র বলেন, মোয়াজ্জেমকে মেডিকেল অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তাঁর সম্পর্কে জানার পর তাঁকে বাদ দেওয়া হয়। তাঁর বিদেশি সব ডিগ্রি ভুয়া।