শুক্রবার

২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

বিরামহীন চেষ্টার সত্ত্বেও আশঙ্কাজনক হারে বেড়েই চলেছে ডেঙ্গুর প্রকোপ

Paris
Update : শনিবার, ৯ অক্টোবর, ২০২১

এফএনএস : স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতর ও সিটি কর্পোরেশনগুলোর এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে বিরামহীন চেষ্টা সত্ত্বেও আশঙ্কাজনক হারে বেড়েই চলেছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। প্রতিদিনই হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত শত শত রোগী ভর্তি হচ্ছে। বলা যায় এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সকল চেষ্টাই বিফলে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এডিস মশার প্রজনন হার বেশি হচ্ছে। ফলে শীতের আগমনী বার্তা শুরুর পরও ডেঙ্গুর প্রকোপ কমছে না। মূলত যতোদিন বৃষ্টি থাকবে ততোদিন ডেঙ্গুও থাকবে। স্বাস্থ্য অধিদফতর এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, এবার ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশার প্রজননের জন্য পরিবেশ খুবই অনুকূল। বছরব্যাপী বৃষ্টি এবং তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা অনুকূলে থাকায় এডিস মশার বংশবিস্তার বেশি হচ্ছে । ৩০ থেকে ৩২ ডিগ্রী তাপমাত্রা ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশার প্রজননের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। এবার প্রায় প্রতিদিনই তেমন তাপমাত্রা বিরাজমান। ফলে এবার এডিস মশার বংশবিস্তার বেশি হওয়ার কারণে ডেঙ্গু রোগের প্রকোপও বেশি। তাছাড়া আর্দ্রতা বেশি থাকার কারণে মাঝে মাঝে বৃষ্টি না হলেও মাটিতে স্যাঁতসেঁতে অবস্থা বিরাজমান থাকছে। ফলে কোন স্থানে এডিস মশা ডিম পাড়লে পানি শুকিয়ে গেলেও ডিম নষ্ট হচ্ছে না।

সূত্র জানায়, একটি এডিস মশা মাসে ২ বার ডিম পাড়ে। প্রতিবার প্রায় ২০০ করে ডিম পাড়ে। ওই হিসেবে বছরে একটি এডিস মশা ডিম পাড়ে প্রায় ৫ হাজার। আর এডিসের ডিম শুকনো মাটিতে পড়ে থাকলেও সুপ্ত অবস্থায় অনেকদিন থাকে। আর যখনই ওই ডিম পানির সংস্পর্শে আসে তখনই লার্ভায় পরিণত হয়। এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এডিস মশার প্রজননকালীন জীবনচক্র দ্রুত শেষ হয়। তাই মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই প্রজনন কার্যক্রম শেষ করছে। বৃষ্টি বা অন্য কোন উপায়ে যে কোনো স্থানে জমে থাকা স্বচ্ছ পানিতে এডিস মশা ডিম পাড়ার ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে লার্ভা পর্যায়ের সৃষ্টি হয়।

৪ থেকে ৫ দিনের মধ্যে লার্ভা থেকে পিউপা পর্যায়ে যায় এবং পিউপা থেকে ১ দিনের মধ্যেই এডিস মশা উড়তে পারে এবং পূর্ণাঙ্গ মশা হিসেবে বিচরণ করে। তখন থেকেই মানুষকে আক্রমণ করে ডেঙ্গু রোগের জীবাণু ছড়িয়ে দিতে পারে। তাছাড়া ম্যালেরিয়া রোগের বাহক এ্যানোফিলিস মশা যেখানে একজনের বেশি মানুষের দেহে রোগ সৃষ্টি করতে পারে না, সেখানে একটি এডিস মশা ৮ থেকে ১২ জনের দেহে আক্রমণ করে ডেঙ্গু রোগ সৃষ্টি করতে পারে। সার্বিকভাবে এবার মশার প্রজনন হার বেশি হওয়ায় ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তের সংখ্যাও বেশি।

সূত্র আরো জানায়, চলতি বছর প্রতি মাসেই দেশে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা আগের মাসের রেকর্ড ভঙ্গ করছে। সেপ্টেম্বরের ৩০ দিনে আগস্ট মাসের ৩১ দিনের চেয়ে বেশি মানুষ ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। আগস্টে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৭ হাজার ৬৯৮ জন। আর সেপ্টেম্বরে আক্রান্ত হয়েছে ৭ হাজার ৮৪১ জন। সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গু রোগী মারাও গেছে বেশি। এ বছর মে মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ৪৩ জন। জুনে ২৭২ জন, জুলাইয়ে ২ হাজার ২৮৬ জন ও আগস্টে ৭ হাজার ৬৯৮ জন। আর সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে প্রায় ৮ হাজার। এ বছর জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ১৮ হাজার ১৯৭ জন মানুষ। আর মারা গেছে ৬৭ জন।

আক্রান্তের সংখ্যায় দেশে এটি দ্বিতীয় ও মৃত্যু সংখ্যায় তৃতীয় সর্বোচ্চ রেকর্ড। বিগত ২০১৯ সালে দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যায় সর্বোচ্চ রেকর্ড সৃষ্টি করেছিল। ওই বছর ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল। আর ওই বছর ডেঙ্গুতে প্রাণ হারায় ১৭৯ জন। স্বাস্থ্য অধিদফতর ২০০০ সাল থেকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর বছরভিত্তিক তথ্য রাখছে। ওই তথ্যানুসারে ২০০০ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ৫ হাজার ৫৫১ জনের মধ্যে ৯৩ জনের মৃত্যু হয়। যা ডেঙ্গু রোগে দেশে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড। তার পর ২০০১ সালে ২ হাজার ৪৩০ জন আক্রান্তের মধ্যে ৪৪ জন মারা যায়।

২০০২ সালে ৬ হাজার ২৩২ জন আক্রান্তের মধ্যে ৫৮ জন মারা যায়। ২০০৩ সালে ৪৮৬ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর মধ্যে মারা যায় ১০ জন। তবে ২০০৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত টানা ৪ বছর ডেঙ্গুতে কোন প্রাণহানি হয়নি। আর ২০০৭ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ৮ বছরের মধ্যে কোন বছরই ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ২ হাজার ছাড়ায়নি। ২০১৫ সাল থেকে দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ আবার বাড়তে শুরু করে। তবে ২০১৭ সালে কমে গেলেও ২০১৮ সালে আবার তা বেড়ে যায়। ২০১২ সালে ডেঙ্গুতে মারা যায় ১ জন, ২০১৫ সালে ৬ জন, ২০১৬ সালে ১৪ জন, ২০১৭ সালে ৮ জন এবং ২০১৮ সালে ২৬ জন মারা যায়।

এদিকে কীটতত্ত্ব ও প্রাণিবিদ্যা বিশেষজ্ঞদের মতে, বছরব্যাপী থেমে থেমে বৃষ্টি হওয়ায় এবার ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশার প্রজনন হার অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশি। বৃষ্টির পর জমে থাকা স্বচ্ছ পানিতে এডিস মশা ডিম পাড়ে। ওই ডিম থেকে হয় লার্ভা। আর ওই লার্ভাগুলো পূর্ণাঙ্গ মশা হওয়ার পর মানুষের দেহে আক্রমণ করে ডেঙ্গু রোগ ছড়ায়। কিন্তু নগরবাসী সচেতন না হওয়ায় বাসাবাড়ি ও আশপাশের বিভিন্ন পাত্রে জমে থাকা পানি পরিষ্কার করছে না।

আর ওই কারণেই ওসব পাত্রে এডিস মশা ডিম পেড়ে দ্রুত বংশবিস্তার করে। অন্যদিকে এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র ও পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডাঃ মোহাম্মদ নাজমুল ইসলাম জানান, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে চেষ্টার কোন কমতি নেই। তবে এ বিষয়ে নগরবাসীর মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে। নগরবাসী সচেতন হলে দ্রুতই ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ কমে আসবে।


আরোও অন্যান্য খবর
Paris