শুক্রবার

২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শৈশবে হারানো কুদ্দুস ৭৮ বছর পর পেলেন পরিবারের ঠিকানা

Paris
Update : শনিবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১

শামীম রেজা : জীবন চলার পথে প্রতিটি মানুষের জীবনে ঘটে নানা ঐতিহাসিক ঘটনা। কোনটা জীবন আর বাস্তবতার সাথে মিলে যায় আরবার কোনটা মিলে না। এমনই একটা বাস্তব ঘটনা ঘটেছে আব্দুল কুদ্দুস মুন্সীর জীবনে। পৃথিবীর ভালো মন্দ বুঝে উঠার আগেই পিতার মাতার ভালোবাসা স্নেহ মায়া মমতা থেকে অনেক দূরে পাড়ি জমিয়েছেন। হারিয়েছেন আপনজনদের ঠিকানা। বলছিলাম শৈশবে অভিমান করে পথহারা শিশু আব্দুল কুদ্দুসের কথা। অজানা পথে হারিয়ে যাওয়ার প্রায় ৭৮ বছর পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পরিচয় মেলে বৃদ্ধ আব্দুল কুদ্দুসের। আব্দুল কুদ্দুস স্ত্রী, সন্তান, নাতি-নাননি নিয়ে বর্তমানে বসবাস করছেন রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার বারুইপাড়া গ্রামে।

এ যেন এক ঐতিহাসিক বাস্তব জীবনের পটভূমি সৃষ্টি হয়েছে। হারিয়ে যাওয়ার ৭৮ বছর পর আপন ঠিকানাসহ আপন জনদের খুঁজে পেয়েছেন তিনি। আব্দুর কুদ্দুস মুন্সীর বয়স এখন প্রায় ৮৫ বছর।
এদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর স্বজনরা দেখা করতে আসেন স্বজনরা। তারা জানান, ছেলের আশায় এখনও পথ চেয়ে আছেন আব্দুল কুদ্দুসের শতবর্ষী মা। তবে তার পিতা অনেক আগেই মৃত্যুবরণ করেছেন বলে জানা গেছে।

কথা হয় আব্দুল কুদ্দুস মুন্সীর সাথে তিনি বলেন, ৭৮ বছর আগে তার পুলিশ সদস্য ফুপার সাথে ব্রহ্মণবাড়িয়া থেকে রাজশাহীর বাগমারায় বেড়াতে আসেন। সেখানে প্রায় ২ বছর থাকেন। ফুপার সাথে থাকাকালীন সময়ে ফুপুর সাথে মনমালিন্য হয়। শিশু বয়সে তার ফুপু মারধর করে তাকে। সেই রাগে বাসা থেকে বের হয়ে আর ফিরেননি আব্দুল কুদ্দুস মুন্সি। অনেক খোঁজা-খুজি করে আর পাওয়া যায়নি।
বিষয়টি পরিবারের সদস্য জানালে পরিবারের সদস্যরা মনে করেন সম্পত্তির লোভে পিতা-মাতার একমাত্র পুত্র সন্তান আব্দুল কুদ্দুসকে হত্যা করা হয়েছে।

৭৮ বছর পর হারিয়ে যাওয়া সেই আব্দুল কুদ্দুস মুন্সীকে খুঁজে পেয়েছে তার পরিবার। ৭ বছরের সেই ছোট্ট শিশুটি আজ ৮৫ বছরের বৃদ্ধ। আব্দুল কুদ্দুস মুন্সী আরো বলেন, কিছু দিন আগে আইয়ূব আলী নামের পরিচিত একজনের কাছে তার হারিয়ে যাওয়া গল্প বলেন । সেই ঘটনাটি ফেসবুক আইডিতে আপলোড দেয়া আইয়ুব আলী। সেখানে তিনি শুধু পিতা-মাতা ও নিজ গ্রাম বাড্ডার নাম বলতে পারেন। পরে ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা বাড্ডা গ্রামের বাসিন্দারা সাড়া দিতে থাকেন। এক পর্যায়ে আব্দুল কুদ্দুসকে খুঁজে পান তার পরিবারের সদস্যরা। আব্দুল কুদ্দুসের স্বজনরা জানান, এখনও জীবিত আছেন তার শতবর্ষী মা ও এক বোন। এরই মধ্যে মায়ের সাথে ভিডিও কলে কথাও বলেছেন আব্দুল কুদ্দুস। আর এত বছর পর নিজের পরিবার খুজে পাওয়ায় খুশি আব্দুল কুদ্দুসের স্ত্রী-সন্তানরাও।

আইয়ুব আলী নামের ওই ব্যক্তি বলেন, আব্দুল কুদ্দুস মুন্সীর হারিয়ে যাওয়ার একটি ভিডিও আমার ফেসবুক পেজে আপলোড করি। আর ফেসবুকে ওই পোস্টের উপরে লিখে ছিলাম যে, ব্রহ্মণবাড়িয়া জেলার নবিনগর থানার এই বৃদ্ধা আজ থেকে প্রায় ৭০ বছর আগে হারিয়ে গিয়ে পরিবার বিচ্ছিন্ন। কেউ যদি তার কথা শুনে চিনতে পারেন। তিনি আরো বলেন, তার পরে বহু মানুষ সেই পোস্ট শেয়ার করেন। বিদেশে কিছু মানুষ ওই এলাকার আমার ফ্রেন্ড লিস্টে আছেন তারা দেখেন। তার পরে ওই এলাকার মানুষ ফেসবুকে আব্দুল কুদ্দুসের ভিডিও শুনে সন্ধান পান তার পরিবারের মানুষ।

আব্দুল কুদ্দুস মুন্সী জানান, আমি ফুপার বাসা থেকে বের হয়ে হাটতে হাটতে আত্রাই সিংসাড়া গ্রাম পর্যন্ত চলে আসি। তখন প্রায় সন্ধ্যা সে সময় খয়মুন নামের এক বৃদ্ধ মহিলার সাথে দেখা হয়। তখন তার বাড়িতে যাওয়ার কথা বলি। তিনি ভিক্ষা করে সংসার চালায়। আমার কথা শুনে ওই মহিলা তার গ্রামের জনৈক হাদেকের ছেলে সাদেকের বাড়িতে নিয়ে যায়। সাদেকের কোন সন্তান না থাকায় আমাকেই ঠাঁই দেয় তাদের বাড়িতে। সেখানেই বড় হই আমি। এমনকি তারাই আমাকে মুসলমানি দেন। পরে পনের বছর বয়সে সাদেক একই এলাকার চৌউড়বাড়ি গ্রামে তাঁর এক আত্মীয়ের মেয়ের সাথে আমার বিয়ে দেয়।

সাদেকের বাড়িতে কয়েক বছর থাকার পর আমার শ্বাশুড়ির মাধ্যমে বাগমারা উপজেলার ঝিকরা ইউনিয়নের বারুইপাড়া গ্রামের নিঃসন্তান সুন্দর বেগম ও কপিজান নামের দুই বোন বাড়িতে আব্দুল কুদ্দুসকে রাখার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তার শ্বাশুড়ি। সেই সময় থেকে আব্দুল কুদ্দুস মুন্সী তার স্ত্রীকে নিয়ে বারুইপাড়া গ্রামে বসবাস শুরু করে। সেখানে বসবাসের বছর দুয়েক পর সন্দর বেগম আব্দুল কুদ্দুসকে ১২ বিঘা জমি রেজিস্ট্র করে দেন। সেখানে আব্দুল কুদ্দুস মুন্সীর তিন ছেলে ও ৫ মেয়ে হয়।

সন্তানাদী নিয়ে বারুইপাড়াতে বসতবাড়ি গড়ে তুলেন তিনি। মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন আর তিন ছেলের মধ্যে ২ ছেলে দেশের বাহিরে থাকেন আর এক ছেলে বারইপাড়া গ্রামেই থাকেন পিতা-মাতাকে নিয়ে। তিনি কোরআনের হাফেজ। তিনি আরো বলেন, আমার মায়ের সাথে ভিডিও কলে প্রথম যখন কথা বলি তখন আমার মা আমাকে বলে তুই আমার হারিয়ে যাওয়া আব্দুল কুদ্দুস বাবা। তোর ছোট বেলায় হাত কেটে গিয়েছিলো। মায়ের মুখে এ কথা শুনার পরে আমি বলি, মা তোর কুদ্দুসের কোন হাত কেটে গিয়েছিলো, তখন মা বলে বাম হাতের বুড়া আঙ্গুল কেটে গিয়েছিলো, তখন আমার মাথা খারাপ হয়ে যায়।

আর বুঝতে পারি যে আমার মা সেই। এদিকে হারিয়ে যাবার ৭৫ বছর পর পরিবারের সাথে যোগাযোগের বিষয়টি আলোড়ন ফেলেছে আব্দুল কুদ্দুসের বর্তমান আবাস বাগমারার বারুইপাড়া গ্রাম সহ বাগমারায়। আজ শুক্রবার বিকেলে মায়ের সাথে দেখা করতে ব্রহ্মণবাড়িয়া যাওয়ার কথা রয়েছে আব্দুল কুদ্দুস মুন্সী সহ তার ছেলেদের। এদিকে পরিচয় সনাক্তের পর ভিডিও কল সহ মোবাইল ফোনের মাধ্যমে তার স্বজনরা কথা বলছেন।


আরোও অন্যান্য খবর
Paris