শুক্রবার

২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

করোনায় মৃত লাশ বহনকারী সাহসী যোদ্ধারা

Paris
Update : মঙ্গলবার, ১০ আগস্ট, ২০২১

শাহানুর রহমান রানা : মহামারিকালীন সময়ে রাতদিন লাশবহনের মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে লিপ্ত আছেন, নিশান, মোহাম্মদ আবু, রবিউল ইসলাম, রাতুল, মাসুম, আলমগীর, রমেশ, জানে আলম, হৃদয়, মিল্টন, রিকো, টুটুল, আরিফ, রিপন, খোকন, ছোট মাসুম, জাহিদ, শরিফুল ইসলাম, শুভ, টুটুল(২), রানা, এনতা ও আলামিনরা। এ পর্যন্ত তারা প্রায় একহাজার করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত ব্যক্তির লাশ বহন করেছেন বলে জানান। এতোগুলো লাশ বহনের পরেও আপনারা আক্রান্ত হননি প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, ‘আল্লাহ্ তালার হয়তো অশেষ রহমত আছে আমাদের উপর। তাছাড়াও আমরা আমাদের কাজ শেষ করে বাসাতে প্রবেশের সময় নিজেদের জামাকাপড় সাবান দিয়ে ভাল করে ধুয়ে গোসল করে প্রবেশ করতাম।

এইরকম ঝুঁকিপূর্ণ কাজের জন্য সরকারীভাবে কিংবা হাসপাতাল ও অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান থেকে আমাদেরকে সুরক্ষাজনিত কোন প্রকার উপকরণ সরবরাহ করা হতো না। নিজেদের অর্থ দিয়েই আমরা গ্লোবস, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও মাস্ক ক্রয় করতাম। এই ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজের জন্য অনেক বেসরকারি ও স্বেচ্ছাসেবি প্রতিষ্ঠানের সদস্যরা সরকারিভাবে আর্থিক অনুদানসহ অন্যান্য সহোযোগিতাও পেয়েছে বলে শুনেছি। কিন্তু আমরা আজ পর্যন্ত কোন প্রকার সহোযোগিতা পেলাম না’। উপরন্তু, এই ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করার পরেও করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন দেবার জন্যও হাসপাতাল কিংবা সরকার থেকে আমাদেরকে বিশেষ কোন সুবিধা প্রদান করা হয়নি।

মৃত্যুর মিছিল দিনদিন বৃদ্ধি পাওয়াতে আমরা আমাদের দায়িত্ব ও পেশাদারিত্ব পালন করতে গিয়ে ভ্যাকসিন দেবার জন্য কখনোই অতিরিক্ত সময় পাইনা। তাই আল্লাহ তালার উপর ভরসা করে নিজেদের পেশাদারিত্ব চালিয়ে যাচ্ছি বলে জানাও তারা। বলছিলাম রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনায় মৃত লাশ বহনকারী সাহসী যোদ্ধাদের কথা।

মাইক্রোবাস ড্রাইভার নিশানসহ তার সহযোদ্ধাদের অনেকেই কোভিড-১৯ ব্যাধিতে মৃত্যুবরণ করা ব্যক্তিদের লাশবহনের বেশ কয়েকটি হৃদয়বিদারক ঘটনা সম্পর্কে জানান। তিনি জানান একাধিক হৃদয়বিদারক ঘটনার মধ্যে অন্যতম হলো, নাটোর জেলার খেজুর নামক এলাকার এক ব্যক্তি কোভিড-১৯ ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করার পর হাসপাতাল থেকে উক্ত ব্যক্তির গোসল করিয়ে দেবার পর ঐ লাশ মৃতব্যক্তির ছেলে মেয়ে স্ত্রী কিংবা অন্যকোন ব্যক্তি লাশটি ধরে মাইক্রোবাসে তুলতে রাজি হননি। উপায়ন্তুর না দেখে চালক নিশান নিজেই লাশটি গাড়িতে তুলে প্রথমে নগরীর সপুরা এলাকায় নিয়ে যান ছেলের বাসায়।

লাশ বাসাতে নেবার পরেও ঐ মৃত ব্যক্তির পরিবারের কেউ একটিবারের জন্যও কাছ থেকে শেষ দেখা দেখতে আসেনি করোনাভাইরাসে আক্রান্তের ভয়ে। পরবর্তীতে সকলের অনুমতি সাপেক্ষে লাশটি মৃতের গ্রামের বাড়ি নাটোরে নিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুতি নেন চালক। লাশটি মাইক্রোবাসের পেছনের সিটের উপর রেখে দূরের পথ যেতে অনেকটাই ভোগান্তি পোহাতে হয় ড্রাইভার নিশানকে। কারণ; দূরের রাস্তাতে লাশের পাশে কেউ বসে না থাকলে সিটের উপর থেকে মৃতের লাশ পড়ে যাবার সমুহ সম্ভাবনা থাকে। তাই লাশের পাশে মৃতের কোন স্বজনকে বসে থাকতে বলেছিলেন চালক নিশান।

কিন্তু, মৃত প্রকৌশলীর সেই লাশের পাশে তাঁর ছেলে মেয়ে কিংবা অন্যকেউ বসে থাকতে রাজি হয়নি। কিছুদূর যাবার পর লাশটি একাধিকবার সিট থেকে নিচে পড়ে যাওয়াতে ড্রাইভার নিশান একটি দড়ি দিয়ে নিজেই ঐ লাশটি সিটের সঙ্গে বেঁধে অবশেষে গন্তব্যস্থানে পৌঁছান। মৃতব্যক্তির পরিবারের লোকজন নাটোরে গিয়েছিলে শীতাতপ নিয়ন্ত্রীত হাইস গাড়িতে। মৃতের গ্রামেরবাড়ি যাবার পরের দৃশ্য দেখে আরো বেশি হতবাগ হয়ে পড়েন বলে জানান নিশান। তিনি বলেন, মৃতের ছেলে মেয়ে তো দূরের কথা, কোন স্বজন বা গ্রামের কেউ সেই লাশ গাড়ী থেকে নামাতে রাজি হচ্ছিলেন না। কোন উপায় না দেখে নিশার নিজেই লাশটি কোলে করে নিয়ে যথার্থস্থানে রেখে দেন। পরে কোয়ান্টামের লোকজন এসে লাশটি দাফন করেন।

শিবগঞ্জের পৌরসভার কানসাট এলাকার চৌডালা গ্রামের এক বাসিন্দা কোভিড-১৯ ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করার পর তিনঘন্টা অতিক্রম হলেও ঐ ব্যক্তির লাশ গ্রহণ করার জন্য ভয়ে তার পরিবারের কেউ আসেনি। কোন ব্যক্তি না আসার জন্য উক্ত লাশ নিয়ে জটিলতায় পড়েন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। অবশেষে লাশবাহী ড্রাইভারের একজন নিজের দায়িত্বে উক্ত লাশটি নিয়ে গন্তব্যস্থানে পৌঁছে দেন। নগরীর ভদ্রাস্থ এক ব্যক্তির লাশ নিয়েও সমস্যায় পড়েন লাশবাহী গাড়ির চালকরা। মৃত ঐ ব্যক্তির লাশ নিতে আসা পরিবারের স্বজনরা লাশ থেকে অনেক দূরে থেকে চালক ও হেলপারদেরকে বলেন, তোমরা লাশটি গাড়িতে তুলে নিয়ে সরাসরি কবরস্থানে নিয়ে যাও, বাড়িতে নেবার কোন প্রয়োজন নেই। ঐ ব্যক্তির এক মেয়ে নাকি মোবাইল ফোনে বেশ কয়েকবার আকুতি মিনতি করেছিলেন বাবার লাশটি শেষ বারের জন্য একবার দেখবে বলে; কিন্তু পরিবারের অন্যরা রাজি হয়নি ফোন করা মৃতের সেই মেয়েটির কথায়।

এদিকে, লাশবাহী মাইক্রোবাসগুলোর স্বত্ত্বধিকারীগণ এ বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, কোভিড-১৯ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে প্রথম প্রথম যারা মৃত্যুবরণ করেছিলেন তাদের লাশ অন্যকোন মাইক্রোবাস বহন করে গন্তব্যস্থানে নিয়ে যেতে চাইতো না। যার কারণে মৃতের পরিবারের স্বজনরা পড়তেন বিপাকে। অনেকেই আমার ব্যক্তিগত চেম্বারে এসে আর্তনাদ করতেন মৃতের লাশটি বহন করে নিজ বাড়ীতে পৌঁছে দেবার জন্য। প্রায় প্রতিনিয়তই এমনটা হয়েছে প্রথম দিকে। একদিকে, আমার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাজের জন্য নিয়মিত হাসপাতালে আসা যাওয়া, তো অন্যদিকে, কোভিড-১৯ ব্যধিকে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করা ব্যক্তির স্বজনদের আমার চেম্বারে আসা যাওয়ার জন্য আমার নিজের পরিবারকে করোনাভাইরাসের মতো ভয়ানক ভাইরাসের হাত থেকে সুরক্ষি রাখার জন্য প্রায় একমাসের বেশি সময় বাসাতে না গিয়ে আমি আমার ব্যবসায়ির চেম্বারেই কাটিয়েছি। জানে আলম জনির নিয়ন্ত্রণাধিনে প্রায় ত্রিশটির মতো মাইক্রোবাস হাসপাতালে আসা রোগীসংশ্লিষ্ট সেবা দিয়ে থাকে।

করোনার প্রাদুর্ভাব ও সংক্রমণ বৃদ্ধির পাশাপাশি মৃত্যুর মিছিলের সংখ্যা দিনদিন বৃদ্ধি পাওয়াতে কোভিড আক্রান্ত রোগির লাশ বহনের জন্য উক্ত মাইক্রোবাসগুলো তিনি কাজে লাগান। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির লাশ বহনের জন্য যখন উক্ত লাশের স্বজনরা ছাড়াও অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান পিছুটান দিতে শুরু করেছিলেন ঠিক সেই সময় জানে আলম জনির মাইক্রোবাসে কর্মরত প্রায় ত্রিশজন ড্রাইভার ও হেলপার (সহোযোগি) আল্লাহ তালার উপর বিশ্বাস রেখে নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নেমে পড়েন কোভিড-১৯ ব্যাধিতে আক্রান্ত মৃতব্যক্তির লাশবহনের কাজে।

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করা ব্যক্তিদের লাশবহনের জন্য ঐসকল চালকদের সাথে এলাকার লোকজনসহ স্বজনরাও মেলামেশা করতো না বলে জানান চালকেরা। তাদেরকে দেখলে অধিকাংশরাই যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে চলাফেরা করতো। বাগধানি এলাকার বাসিন্দা লাশবাহি গাড়ির চালক শরিফুলকে তো গ্রামের মেম্বার চেয়ারম্যানসহ গ্রামের লোকজন তার নিজ গ্রামে প্রবেশই করতে দেয়নি লাশবহনের কাজে নিয়োজিত থাকার জন্য। চালক শরিফুল তাই বাধ্য হয়েই সপ্তাহখানেক হাসপাতালের বিভিন্নস্থানে রাত কাঁটান। অবশেষে ৯৯৯ (ট্রিপল নাইনে) ফোনে করে সহোযোগিতা চেয়ে আটদিন পরে তিনি তার নিজের গ্রামের বাড়িতে প্রবেশ করতে পারেন।

দেশে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধির সাথে সাথে কোভিড-১৯ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করছেন অসংখ্য মানুষ। প্রথম থেকে এ পর্যন্ত অধিকাংশের কপালেই জোটেনি পরিবার কিংবা স্বজনদের কাছ থেকে চিরবিদায় বেলায় শেষ দেখার মতো বিষয়টিও। বাবা-মার লাশের কাছে আসাতো দূরের কথা, হাসপাতাল থেকে জন্মদাতার মৃত দেহটিও নিতে আসেনি অনেকেই। যারা ছোট বেলা থেকে অনেক কষ্ট আর গ্লানি সহ্য করে প্রতিষ্ঠিত করেছেন নিজের সন্তানদের; করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করা সেই হতভাগা বাবা-মা’র লাশের কাছে এসে শেষ বিদায়টিও দিতে কার্পণ্যবোধ করেছেন নিজেদের সুরক্ষার কথা বিবেচনা করে।

বাবার লাশ এ্যাম্বুলেন্স কিংবা লাশবাহী মাইক্রোবাসে নিয়ে যাবার সময় গাড়ীর সিট থেকে একাধিকবার লাশ নিচে পড়ে যাবার পরেও রাশের পাশে বসেনি পরিবার কিংবা স্বজনদের কেউ; এমনও ঘটনাও আছে যে, মৃতের লাশ গ্রহণ করার জন্যও ভয়ে কেউ আসেনি হাসপাতালে। টাকার বিনিময়ে লাশবহন করা গাড়ীর চালকদের দিয়েই হাসপাতাল থেকে কবর পর্যন্ত পৌঁছে দেবার কাজটি করেছেন অনেক পরিবার। সেই নিষ্ঠুরতা, নির্মমতা, কষ্টের কাহিনী নিয়েই লাশবহন করা চালক ও হেলপারদের সাথে আলাপ হয় রামেক হাসপাতালের কোভিড ইউনিটের সামনে।


আরোও অন্যান্য খবর
Paris