শুক্রবার

২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দেশে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে ক্যান্সারজনিত শিশু মৃত্যু হার

Paris
Update : সোমবার, ৯ আগস্ট, ২০২১

এফএনএস : ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দেশে আশঙ্কাজনক হারে শিশু মৃত্যু হার বাড়ছে। দেশে শিশুস্বাস্থ্যে বড় এক সংকট হয়ে দেখা দিয়েছে ক্যান্সার। প্রাপ্তবয়স্কদের মতো এখন শিশুদের মধ্যেও প্রাণঘাতী ব্যাধিটির প্রকোপ বাড়ছে। দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সংস্থার গবেষণার তথ্যমতে, ২৯ মাস থেকে ১১ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যেও ক্যান্সারজনিত মৃত্যুহার বেড়েই চলেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) দেশের ৪০টি জেলায় শিশু মৃত্যুর কারণ খুঁজতে জরিপ চালায়। ওই জরিপের এক প্রতিবেদনে দেশে এখন শিশুমৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণ হিসাবে ক্যান্সার চিহ্নিত হয়েছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, বিভিন্ন জরিপের ফলাফলের চেয়ে দেশে ক্যান্সারে মৃত্যুর সংখ্যার হার আরো অনেক বেশি। কারণ আক্রান্ত শিশু ক্যান্সার নির্ণয় বা চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকের কাছে আসার পরই তাদের তথ্য জানা সম্ভব হয়। তার বাইরেও অনেক শিশু-কিশোর বাড়িতে বিনা চিকিৎসায় বা অপচিকিৎসায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। স্বাস্থ্য খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সূত্র মতে, জিনগত পরিবর্তন হচ্ছে ক্যান্সারের মূল কারণ। তাছাড়া ভেজাল খাদ্য, খাদ্যে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার, বায়ুদূষণ ও বিকিরণের মাত্রা বৃদ্ধির ফলে শিশুদের মধ্যে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ছে। তবে শিশুদের মধ্যে ব্লাড ক্যান্সারের প্রাদুর্ভাবই বেশি। তাছাড়া ব্রেন, কিডনি, কোলন, লিভার ও হাড়ের ক্যান্সারেও শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে। দেশে প্রাদুর্ভাব বাড়লেও শিশু ক্যান্সারের চিকিৎসায় এখনো অনেক পিছিয়ে রয়েছে। বড়দের ক্যান্সার চিকিৎসার যতোটুকু সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়, শিশুদের ক্ষেত্রে তার সিকিভাগও নেই। ঢাকাকেন্দ্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং শয্যা ও যন্ত্রপাতিসহ প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গের অভাবে চিকিৎসা সুবিধা বাড়ছে না।

জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং বিএসএমএমইউর পেডিয়াট্রিক অনকোলজি বিভাগসহ হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে শিশুদের ক্যান্সার চিকিৎসা দেয়া হয়। পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরও সংকট রয়েছে। দেশে মাত্র দুজন ক্যান্সার চিকিৎসায় বিশেষজ্ঞ ফার্মাসিস্ট রয়েছেন। বর্তমানে ওসব সংকটকে আরো গভীর করে তুলেছে করোনা মহামারী। সূত্র জানায়, দেশে দুর্বল সরকারি ও স্থানীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার কারণে শিশুদের ক্যান্সার নির্ণয়ে অনেক দেরি হয়ে যায়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু হেমাটোলজি ও অনকোলজি বিভাগে প্রতি বছর গড়ে ৫০০ শিশুকে ক্যান্সারের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। কিন্তু কভিড পরিস্থিতিতে শিশুদের ক্যান্সারের চিকিৎসা গ্রহণের হার প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে।

বিগত ২০১৯ সালে সেখানে ১২ বছরের কম বয়সী ৪১৪ জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছে। বর্তমানে করোনা সংক্রমণের ভয়ে অনেকেই চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে আসছে না। আবার চিকিৎসার জন্য যে ব্যয় হয় তা বহনের সক্ষমতাও অনেক পরিবারের নেই। আর ক্যান্সার চিকিৎসায় যেসব ওষুধ ব্যবহার হয়, তার অনেকগুলোই বাজারে সহজলভ্য নয়। তবে ক্যান্সার আগের মতো এখন মরণব্যাধি নয়। ক্যান্সার হলেও মানুষ বাঁচে। কিন্তু বাঁচাতে গেলে পরিপূর্ণ সমর্থন প্রয়োজন। ক্যান্সার ইনস্টিটিউটে রোগীর অতিরিক্ত চাপের কারণে প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা শুরু করা সম্ভব হয় না। আর দীর্ঘসূত্রতায় রোগ জটিল আকার ধারণ করে। স্টেজ ওয়ানে চিকিৎসকের কাছে এলেও অনেক সময় শয্যা না থাকায় রোগী ভর্তি করাতে করাতে ক্যান্সার স্টেজ তিনে পৌঁছে। তখন আর কিছু করার থাকে না।

যদিও দেশে মৃত্যুপথযাত্রী ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের কষ্ট বা বেদনা প্রশমনে ‘প্যালিয়েটিভ কেয়ার’ খুবই সীমিত পরিসরে চালু রয়েছে। কিন্তু ওই সুবিধা পাওয়া প্রাপ্তবয়স্কদের চেয়ে শিশুদের অনেক কম। আর যতোটুকু পাওয়া যায় সেটুকু বহনের আর্থিক সামর্থ্যও অধিকাংশ শিশুর পরিবারের নেই। তাছাড়া দেশে শিশুদের ক্যান্সার শনাক্তের হার বাড়লেও চিকিৎসা সম্প্রসারিত হচ্ছে না। তাছাড়া ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকও খুব কম। দেশে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে ২০-২২ জন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। কিন্তু আরো বেশি বিশেষজ্ঞ তৈরি করা জরুরি। চিকিৎসক তৈরির পাশাপাশি শিশু ক্যান্সার নিরাময়ের জন্য এ বিষয়ে অভিজ্ঞ নার্স ও টেকনিশিয়ানও প্রয়োজন। কিন্তু দেশে এখনো অভিজ্ঞ নার্স কিংবা টেকনিশিয়ানের অভাব রয়েছে।

বিদেশে শুধু শিশু ক্যান্সারের ওপর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ান তৈরি করা হয়। কিন্তু এদেশে সে সুযোগ নেই। আর ঢাকার বাইরে শিশু ক্যান্সার চিকিৎসা তেমন উন্নত নয়। ঢাকার বাইরে শুধু চট্টগ্রামে একজন শিশু ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। এদিকে ইন্টারন্যাশনাল চাইল্ডহুড ক্যান্সার (আইসিসি) বলছে, প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী প্রায় আড়াই লাখ শিশু ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। ভারত ও পাকিস্তানে শিশু ক্যান্সার রোগীদের একটি যথাযথ পরিসংখ্যান থাকলেও এদেশে তা নেই। যে পরিসংখ্যান হচ্ছে তা শুধু সামনে আসা তথ্যের ভিত্তিতে হচ্ছে। যে কারণে ক্যান্সারে শিশুমৃত্যুর যে পরিসংখ্যান পাওয়া যায়, প্রকৃত সংখ্যা তার চেয়ে অনেক বেশি।

অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক ডা. গোলাম মহিউদ্দিন ফারুক জানান, ক্যান্সার চিকিৎসায় অবকাঠামোসহ সব ধরনের সংকট রয়েছে। চিকিৎসার সুযোগ তৈরি করতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরও এগিয়ে আসতে হবে। বিগত ২০০৮ সালে বাংলাদেশ সরকার ৮টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পেডিয়াট্রিক হেমাটোলজি অ্যান্ড অনকোলজি বিভাগ চালু করে। ২০০৫ সালে চিকিৎসা শুরু করে জাতীয় ক্যান্সার হাসপাতাল ও গবেষণা ইনস্টিটিউট। সরকারের অর্থায়নে প্রথম ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ২০১০ সালে চিকিৎসা শুরু করে। ২০১৪ সালে শিশু হাসপাতালও এ চিকিৎসা শুরু করে। সরকারি বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা শুরু হওয়ার পর বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানেও এ চিকিৎসা শুরু হয়।


আরোও অন্যান্য খবর
Paris