বৃহস্পতিবার

২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নষ্ট ও ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে বিপুলসংখ্যক বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি

Paris
Update : মঙ্গলবার, ২৭ জুলাই, ২০২১

এফএনএস : দেশের দেড় ডজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরিতে গত ৬ বছরে বিপুলসংখ্যক বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি নষ্ট ও ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। তার মধ্যে নষ্ট হয়েছে এক হাজার ১৬৮টি বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি এবং একই সময়ে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে কিন্তু মেরামতযোগ্য এমন যন্ত্রের সংখ্যা ৪ হাজার ৩৮৯টি। ‘বাংলাদেশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের শিক্ষা সুবিধাদি উন্নয়নকল্পে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ক্রয়’ শীর্ষক প্রকল্পের প্রভাব মূল্যায়ন প্রতিবেদনে ওই তথ্য উঠে এসেছে।

ওই প্রকল্প মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের আওতায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বাস্তবায়ন করে। ওই প্রকল্পের বাস্তবায়নকাল ছিল ২০০৯ সালের জুন মাস থেকে ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত। আর প্রকল্পে মোট ব্যয় ছিল ২০ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-গবেষক এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রকল্পের আওতায় অপরিকল্পিতভাবে যন্ত্রপাতি কেনাকাটা করা হয়। মূলত বৈদেশিক অর্থায়নে ওসব প্রকল্পে গবেষকদের যা চাহিদা তা ক্রয় করা হয়নি। ফলে বেশির ভাগ যন্ত্রই অব্যবহৃত থেকে নষ্ট হয়ে রাষ্ট্রের ক্ষতি কোটি কোটি টাকা হয়েছে। প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করার পাশাপাশি আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সাময়িক জ্ঞান অর্জন করা।

ওই প্রকল্পের আওতায় দেশের ১৮টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ৪৮ হাজার ৬০টি বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়। প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ৮২.৩ শতাংশ অর্থাৎ প্রকল্প সমাপ্ত করতে ব্যয় হয়েছে মোট ১৭ হাজার কোটি টাকা এবং ভৌত অগ্রগতি ১০০ শতাংশ। ওই ১৮ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় (কুষ্টিয়া), শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (সিলেট),

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (গাজীপুর), হাজী মো. দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (দিনাজপুর), মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (টাঙ্গাইল), পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।

সূত্র জানায়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে বেশি নষ্ট ও মেরামতযোগ্য গবেষণা যন্ত্রপাতি রয়েছে। ওই প্রতিষ্ঠানে প্রকল্পের আওতায় মোট প্রাপ্ত যন্ত্রপাতির সংখ্যা ৮ হাজার ১২৭টি। তার মধ্যে সচল রয়েছে ৬ হাজার ৫৩৫টি যন্ত্র আর মেরামতযোগ্য ও নষ্ট হওয়া যন্ত্রের পরিমাণ এক হাজার ৫৯২টি। তারপরেই আছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকল্পের আওতায় মোট প্রাপ্ত যন্ত্রপাতির পরিমাণ ৭ হাজার ৫২৬টি।

তার মধ্যে সচল রয়েছে ৬ হাজার ৫৭৮টি যন্ত্র আর মেরামতযোগ্য ও নষ্ট হওয়া যন্ত্রের পরিমাণ ৯৪৮টি। তারপরেই আছে কুষ্টিয়ার ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়। ওই প্রতিষ্ঠানে প্রকল্পের আওতায় মোট প্রাপ্ত যন্ত্রপাতির সংখ্যা ৭ হাজার ৯৬৯। তার মধ্যে সচল আছে ৭ হাজার ৩৩৮টি যন্ত্র এবং মেরামতযোগ্য ৪১৩টি ও নষ্ট ২১৮টি যন্ত্র। আর সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকল্পের আওতায় প্রাপ্ত বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির সংখ্যা মাত্র ৪৫৬টি।

তার মধ্যে সচল রয়েছে ৪১৬টি যন্ত্র। তবে যন্ত্রের দিক দিয়ে তার থেকে কিছুটা এগিয়ে আছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। ওই প্রতিষ্ঠানে প্রকল্পের আওতায় মোট প্রাপ্ত বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির সংখ্যা ৫৫১টি, তার মধ্যে সচল আছে ৪৭৮টি। বৈজ্ঞানিক যন্ত্রের দিক দিয়ে ওই দুই প্রতিষ্ঠানের চেয়ে কিছুটা এগিয়ে থাকলেও ঢাকার প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

ওই প্রতিষ্ঠানে যন্ত্রপাতি প্রকল্পের আওতায় মোট প্রাপ্ত বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির সংখ্যা ৬১৮। তার মধ্যে সচল ৫৮০টি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে কম যন্ত্রপাতি রয়েছে। তবে তা নিয়ে সন্তুষ্ট ওই প্রতিষ্ঠানের উপাচার্য। তার মতে, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় খুবই ছোট একটি বিশ্ববিদ্যালয়। তবে প্রতিষ্ঠানটি সারা দেশের সব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে গবেষণার দিক দিয়ে এগিয়ে আছে।

সূত্র আরো জানায়, এক জরিপে দেখা যায় ৫৬ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করে যে ব্যাবহারিক ক্লাসের আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ওই সমীক্ষার ৩৮ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করেন যে তাদের আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ওই প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আর প্রকল্পের আওতায় ক্রয় করা যন্ত্রপাতিগুলো অধিক প্রয়োজনীয় বলে মন্তব্য করেছে গবেষণায় অংশগ্রহণ করা ৭৫.৩ শতাংশ শিক্ষার্থী। আর আইএমইডির প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী ওই প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে ৯২.৯ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করে তাদের গবেষণার পথ প্রশস্ত হয়েছে। আর ৯৫.৫ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করে উচ্চশিক্ষায় প্রবেশাধিকার বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।

এদিকে শিক্ষক-গবেষকদের মতে, গবেষণা কাজে আধুনিক বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির গুরুত্ব অনেক। বিশেষ করে সায়েন্সের ক্ষেত্রে ওই অবদানকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তবে এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ল্যাবরেটরির আধুনিক যন্ত্রপাতির যে দশা তার অন্যতম কারণ হচ্ছে অপরিকল্পিত ক্রয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ফান্ড পায় আর যন্ত্রপাতি ক্রয় করে। কিন্তু কী যন্ত্রপাতি লাগবে তা সঠিকভাবে জানে না। মূলত যন্ত্রপাতির চাহিদা ভেতর থেকে নয়, ওপর থেকে আসে। তাতে অর্থের অপচয় হয়। ব্যাহত হয় গবেষণা কার্যক্রম। গবেষকদের স্বার্থে গবেষণাকেন্দ্রিক যন্ত্রপাতি ক্রয় এবং এর পাশাপাশি গবেষণার জন্য বরাদ্দ দেয়ার প্রতি গুরুত্বারোপ জরুরি।

অন্যদিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির ক্রয় ও ব্যবহার বিষয়ে আইএমইডির সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী জানান, পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনেক যন্ত্রপাতি নষ্ট এবং অনেকগুলো মেরামতযোগ্য। ঠিক কেন কী কারণে নষ্ট হলো, তা বলা কঠিন। আশা করা যায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের ভুল-ত্রুটিগুলো দূর করে সঠিক পদ্ধতিতে গবেষণা কাজ চালাবে এবং বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতিগুলো রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে সচল রাখবে।


আরোও অন্যান্য খবর
Paris