বৃহস্পতিবার

২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সর্বশেষ সংবাদ
রাজশাহীতে গ্রীন প্লাজা’র ৫ম প্রকল্পের ‘গ্রীন ছায়েরা মঞ্জিল’ এর শুভ উদ্বোধন মাঠ পর্যায়ের তথ্য সংগ্রহের জন্য কর্মশালা অনুষ্ঠিত থাইল্যান্ডে শেখ হাসিনা লাল গালিচা সংবর্ধনা সাবধান! রাজশাহীতে নকল ফ্লেভার্ড ড্রিংকস-আইস ললি রাজশাহীতে জোরপূর্বক একাধিক ফ্ল্যাট দখলের অভিযোগ এক পুলিশ সুপারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ-কাতার ১০ চুক্তি সই গোদাগাড়ীতে সাড়ে ৬ কেজি হেরোইনসহ মাদক ব্যবসায়ি এজাজুল হক ঝাবু গ্রেফতার রাজশাহীতে বৃষ্টির জন্য কোথাও ইসতিসকার নামাজ আদায় আবার কোথাও ব্যাঙের বিয়ে রাজশাহীর পদ্মা নদীতে গোসলে নেমে ৩ মাদ্রাসা শিক্ষার্থীর মৃত্যু রাজশাহীতে প্রতারণার ক্লু ধরে শিক্ষা উপবৃত্তির টাকা আত্মসাত চক্রের মুল হোতসহ ৮ জন গ্রেফতার

নওগাঁয় ১৯ পরিবারকে সর্বশান্ত করা সেই আদমব্যাপারী গ্রেপ্তার

Paris
Update : সোমবার, ১৯ জুলাই, ২০২১

নওগাঁ প্রতিনিধি : বিদেশে শ্রমিক পাঠানো, প্রবাসী শ্রমিকদের আকামা এবং ভালো কাজ পাইয়ে দেয়ার নাম করে ১৯জনের কাছে প্রায় কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে করা মামলায় একজনকে গ্রেফতার করেছে নওগাঁ সদর মডেল থানা পুলিশ। আদমব্যাপারী সবুজের প্রতারনায় এলাকার ১৯টি পরিবার এখন সর্বশান্ত। পরিবারগুলো এখন মনবেতর জীবন যাপন করছে।

শনিবার সকালে ভুক্তভোগি পরিবারদের পক্ষ থেকে ৪ জনের নাম উল্লেখ করে মানব পাচার দমন আইনে মামলাটি করেন নওগাঁ সদর উপজেলা শিকারপুর ইউনিয়নের চকরামকানু গ্রামের মৃত কফিল উদ্দিন মন্ডলের ছেলে সিরাজুল ইসলাম। মামলার আসামীরা হলেন, নওগাঁ সদর উপজেলার শিকারপুর ইউনিয়নের চককালিদাস গ্রামের মৃত কমর উদ্দিন সরদারের ছেলে মো. সবুজ হোসেন (৩০), একই গ্রামের মৃত ইয়াকুব আলী সদরদারের ছেলে মো. আব্দুল খালেক (৫৫),

মৃত মকবুল হোসেনের ছেলে মো. আবুল কালাম আজাদ (৪০) এবং মৃত কমর উদ্দিনের স্ত্রী রাবেয়া বেগম ওরফে ভুদি (৪৮)। মামলা দায়েরের পর পুলিশ অভিযান চালিয়ে প্রধান আসামী সবুজ হোসেনকে নিজ বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের পর রোববার দুপুরে আদালতের মাধ্যমে তাকে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। আদমব্যাপারী সবুজের খপ্পরে পড়ে এলাকার ১৯টি পরিবার এখন সর্বশান্ত। তাদের পরিবার ও পরিবারের প্রবাসীরা উভয়েই এখন মনবেতর জীবন যাপন করছে।

মামলায় সিরাজুল ইসলাম উল্লেখ করেন, তার ছেলে রুবেল হোসেনকে গত বছরের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে সৌদি আরবে নিয়ে গিয়ে ভালো বেতনে কাজ পাইয়ে দেয়ার কথা বলে প্রধান আসামী সবুজ হোসেন। এরপর তার কথা মত ৬লাখ টাকা তার মা রাবেয়া বেগম (৪নং আসামী) এর কাজে জমা দেয়। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসের ১০তারিখে রুবেল হোসেনকে সৌদিতে আরবে নিয়ে গিয়ে তার কাছে রেখে ভালো কাজ ও বৈধ্য কাগজপত্র করে দেয়ার কথা বলে।

কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন কাজ ও বৈধভাবে কাজের অনুমতি নিয়ে দিতে পারেনাই। বর্তমানে অবৈধভাবে সেখানে মানবেতর জীবন যাবন করছেন। এরপর প্রধান আসামী সবুজ হোসেনসহ মানব পাচার চক্রের সদস্যরা সম্মলিতভাবে স্থানীয় চক কালিদাস গ্রামের আব্দুল লতিফের ছেলে আয়নাল হোসেন (২৮), আব্দুল জবাবারের ছেলে হোসেন আলী (২৫), মৃত আতোয়ার রহমানের ছেলে জিয়াউর রহমান, গোয়ালী গ্রামের ইয়াদ আলী মন্ডলের ছেলে আইজুল মন্ডল, রঘুনাথপুর গ্রামের বাবুল হোসেনের ছেলে জুয়েল হোসেন (৩২), রমজান আলীর ছেলে সাইদুল ইসলাম (৩৩) এর কাছে থেকে সৌদি আরবে নিয়ে যাওয়ার জন্য উল্লেখিত তার সহযোগী তিন আসামীর সহায়তায় প্রায় ৭৩ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সবুজ হোসেন।

এরপর তাদের সৌদিতে আরবে নিয়ে গিয়ে সিরাজুল ইসলামের ছেলেসহ ৭জনকে কোন বৈধ কাগজপত্র ও ভালো কাজ না দিয়ে ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোড়পূর্বক তার তত্ত্বাবধানে কাজ করাচ্ছেন। কিন্তু মাসিক কোন পারিশ্রমিক দিচ্ছেননা শুধু মাত্র কিছু খাবার খরচ ছাড়া। অনেক সময় কাজ না থাকলে না খেয়ে থাকতে হয়। একসঙ্গে গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে ১০-২০জনের।

অন্যস্থানে কাজ করা এবং বৈধ কাগজপত্র করে দেয়ার কথা বললে সবুজ হোসেন নানাভাবে প্রাণনাশের হুমকি দেয়। বর্তমানে প্রতারনার স্বীকার ব্যক্তিরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন সৌদি আরবে। গতমাসে সবুজ হোসেন দেশে ফিরে আসলে প্রতারনার স্বীকার পরিবারদের সদস্যরা তার কাছে গেলে উল্টো তাদেরই হুমকি দিয়ে তাড়িয়ে দেয়।

এ বিষয়ে মামলার বাদী সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমার ছেলে রুবেল হোসেনকে সৌদি আরবে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে আমার কাছে থেকে ৬লক্ষ টাকা নেয় সবুজ হোসেন। সেসময় সবুজ সৌদিতে অবস্থায় করছিল। সবুজের কথা অনুযায়ী ২নং আসামী আব্দুল খালেক, ৩নং আসামী আবুল কালাম আজাদের উপস্থিতিতে ৪নং আসামী রাবেয়া বেগম ওরফে ভুদিকে ২০১৯সালের অক্টোবর মাসের ১০তারিখে নগদ ৬লক্ষ টাকা দিয়েছিলাম।

কিন্তু ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসের ১০তারিখে আমার ছেলে রুবেলকে নিয়ে যাওয়ার পর কোন বৈধ কাগজপত্র ও ভালো কাজ না দিয়ে পাসপোর্টসহ জরুরি কাগজপত্র জোড়পূর্বক কেড়ে নিয়ে তার তক্তাবধানে কাজ করে নেয় কিন্তু তার বিনিময়ে কোন মাসিক প্রারিশ্রমিক দেয়না। শুধু মাত্র সামান্য কিছু খাবার খরচ দেয়। অন্য স্থানে কাজের কথা বললে আমার ছেলেকে নানাভাবে ভয়ভীতিসহ প্রাণনাশের হুমকি দেয়।

বর্তমানে আমার ছেলে অনিরাপত্তায় এবং মানবেতর জীবন যাবন করছেন। এর গত জুন মাসের ২৫তারিখে এজাহার বর্ণিত ১নং আসামী সবুজ হোসেন সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরলে তার গ্রামের বাড়িতে আমিসহ এজাহারে উল্লেখিত ভুক্তভোগি ৭টি পরিবারের সদস্যরাসহ প্রতারিত ১৯টি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তার বাড়িতে গিয়ে তাকে আমরা বলি আমাদের সন্তানদের সাথে এমন প্রতারনা কেন করা হলো। সেই সাথে প্রতারিতদের দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হোক, না হলে সেখানে সকলের প্রয়োজনীয় কাজের ব্যবস্থা করে দেয়া হোক।

এমন দাবি জানালে তিনি সকল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমি যাদের বিদেশে নিয়ে গিয়েছি তাদের অনেককেই ভালো আছে। কাজ করছে। আর যাদের সামন্য সমস্যা আছে তাদের বিষয়ে বিদেশে আবার গিয়েই সমস্যার সমাধান করবো। আমার বাড়িতে এসে কোন ধরনের ডির্স্টাব করবেন না বলে আমাদের তাড়িয়ে দেয়। কিন্তু আমরা জোড়ালো প্রতিবাদ জানালে উল্টো আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা হয়রানিমূলক মামলা দেয়ার হুমকি দেয়। তিনি আরও বলেন, মামলার পর পুলিশ সবুজকে গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে জেলে পাঠিয়েছে। কিন্তু আরও তিন আসামী পলাতক রয়েছে। তাদেরও গ্রেফতার করে কঠিন শাস্তি দেয়া হোক।

সৌদিতে অবস্থানকারী প্রতারিত আয়নাল হোসেনের পিতা আব্দুল লতিফ বলেন, আমার ছেলেকে সৌদিতে ভালো কাজ পাইয়ে দেয়ার কথা বলে ২০২০ সালের জুন মাসে ৭ লাখ টাকা নেয়। সেই সময় প্রতারক সবুজ সৌদিতে ছিল। টাকাগুলো তার কথা অনুযায়ী তার মা রাবেয়া বেগমকে দিয়েছিলাম। আমার ছেলেকে সৌদি নিয়ে কাজ তো দূরের কথা কোন বৈধ কাগজ করে দেয়নি। এখানে যে কর্মরত কোম্পানির নিয়োগপত্র পাঠিয়েছিল তা পুরোটাই ভূয়া। সেটা আমরা কেউই বুঝতে পারিনি। আমার ছেলে বর্তমানে সৌদিতে অনেক কষ্ট আছে।

মাঝে মাঝে ফোন করে অনেক কান্নাকাটি করে আর বলে আব্বা সবুজ আমাদের সাথে প্রতারনা করেছে। শুধু আমি নয় আরও অনেকের সাথেই প্রতারনা করেছে। আব্বা আমাকে দেশে দিয়ে যান। এখানে থাকলে আমি বাঁচবোনা। বাবা হয়ে সন্তানের এমন কান্না আমি সহ্য করতে পারছিনা। কখন যে সেদেশের পুলিশ আটক করে জেলে দিবে সে আতংঙ্কে আছে আমার ছেলেটা। বার বার সবুজ ও তার পরিবারের কাছে ছেলের সমস্যা সমাধানের কথা বললে উল্টো আমাকেই হুমকি দেয়।

আর বলে মিথ্যা মামলায় ফাসায়ে দিবো। সৌদিতে অবস্থানকারী প্রতারিত সাইদুল ইসলামের স্ত্রী নিপা বেগম জানান, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে আমার স্বামীকে সৌদিতে ৬লক্ষ টাকার বিনিময়ে নিয়ে যায়। কাগজপত্র (আকামা) ঠিক করার কথা বলে আরও তিন লক্ষ টাকা নেয়। ৬মাস তার মাধ্যমে কাজ করিয়ে ৩লক্ষ টাকা পাওনা টাকা রয়েছে সেটাও দেয়নি। আমার স্বামী বর্তমানে খুব কষ্টে আছে। আমরা গরীব মানুষ বাড়িতেও টাকা দিতে পারছেনা।

অনেক কষ্টে আমাদের সংসার চলছে। আমার স্বামী ফোন করে কাঁদে আর বলে এ কেমন আজাব দিচ্ছে সবুজ। এলাকার ছেলে হয়ে এমন প্রতারনা করতে পারলো। আমরা সবুজসহ প্রতারনাকারীদের সঠিক বিচার চাই। সেই সাথে আমার স্বামীসহ যারা বিদেশে কষ্টের মধ্যে আছে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হোক অথবা বৈধ কাগজপত্রের ব্যবস্থা করে দেয়া হোক। নইলে আমাদের পথে বসতে হবে।

নওগাঁ সদর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ নজরুল ইসলাম জুয়েল জানান, বিদেশে শ্রমিক পাঠানো, প্রবাসী শ্রমিকদের আকামা এবং ভালো কাজ পাইয়ে দেয়ার লোভ দেখিয়ে প্রতারনার অভিযোগে মানব পাচার দমন আইনে ৪জনের নাম উল্লেখ করে মামলা হয়েছে। মামলার প্রেক্ষিতে প্রধান আসামী সবুজ হোসেনকে গ্রেফতার করে আজ দুপুরে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে।

অন্য তিন আসামী বর্তমানে পলাতক রয়েছে। তাদেরকেও গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। এজাহারে উল্লেখিত ৭জনের নিকট থেকে ২০১৯ সাল থেকে শুরু করে এ যাবৎ পর্যন্ত প্রায় ১৯জনের সাথে বিদেশে ভালো চাকুরি পাইয়ে দেয়ার নাম করে নিয়ে গিয়ে প্রতারনা করেছেন। প্রতারনার ফাঁদে ফেলে প্রায় কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন এই প্রতারক চক্রটি।

ওই ১৯জন ব্যক্তি বর্তমানে সৌদি আরবে অবস্থান করছেন। তদন্তে যতটুকু জানতে পেরেছি তাদেরকে কোন বৈধ কাগজপত্র না দিয়েই তাদের সাথে প্রতারনা করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে তারা অনেক সমস্যায় আছেন। আমাদের কাছে আরও কয়েকজন প্রতারনার স্বীকার পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেছেন। আমরা এই প্রতারণা চক্রটির বিষয়টি গুরুত্বসহকারে তদন্ত করছি।


আরোও অন্যান্য খবর
Paris