বৃহস্পতিবার

২৮শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

১৪ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

হংকংকে পাল্টে নিচ্ছে চীন

Paris
Update : বৃহস্পতিবার, ১ জুলাই, ২০২১

এফএনএস : যে অদৃশ্য রেখাটি কমিউনিস্ট চীন আর গণতান্ত্রিক হংকংকে আলাদা করে রেখেছিল, প্রতিটি দিন একটু একটু করে তা মিলিয়ে দিচ্ছে। নিউ ইয়র্ক টাইমস এক প্রতিবেদনে লিখেছে, চীনের কমিউনিস্ট পার্টি পাল্টে দিচ্ছে হংকংকে, একসময়ের ‘স্বাধীনচেতা’ এ শহরের প্রাণচঞ্চল্য শুষে নিচ্ছে; আরও বেশি স্পষ্ট হয়েছে কর্তৃত্বপরায়ণ শক্তি, যা আগে কখনোই করা হয়নি। ২০২০ সালের ৩০ জুন হংকংয়ে জাতীয় নিরাপত্তা আইন (এনএসএল) প্রবর্তন করে চীন। এর আগের বছর গণতন্ত্রপন্থিদের ব্যাপক বিক্ষোভে বছরজুড়েই কার্যত অচল ছিলো এক সময়ের এই ব্রিটিশ উপনিবেশ।

বিতর্কিত এই আইন হংকংয়ের নিজস্ব বিচারিক ক্ষমতার স্বাধীনতা খর্ব করে এবং বিক্ষোভকারী ও অধিকারকর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পথ সহজ করে দেয়। বিদেশি কোনো শক্তির সঙ্গে আঁতাত করা, তাদের সঙ্গী হওয়া এবং তাদের কর্মকাণ্ডে সহায়তা করাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয় এই আইনের অধীনে এবং এর দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পর্যন্ত শাস্তি হতে পারে।

আইনটি কার্যকর হওয়ার পর এর বিভিন্ন ধারার অধীনে শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে- যাদের মধ্যে আছেন বিক্ষোভকারী, গণতন্ত্রকামী রাজনীতিক ও সাংবাদিক। হংকংকে চাপে ফেলে বেইজিংয়ের এই ‘বদলে ফেলার’ নীতির প্রভাব পড়েছে শহরের দৈনন্দিন জীবনযাপনেও। বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, নতুন আইন শহরের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য দরকার।

কিন্তু সমালোচকেরা বলছেন, এটা ‘এক দেশ, দুই ব্যবস্থার’ নীতি লঙ্ঘন করেছে, যে নীতি অনুসরন করে সাবেক এই ব্রিটিশ উপনিবেশকে চীনের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। হংকংয়ের অনেক বাসিন্দাই স্বীকার করছেন যে, নতুন আইনটি কার্যকর করার পর সেখানে জীবনযাপনের ধারাতেই মৌলিক বদল এসেছে। বাসিন্দাদের অনেকেই এখন পুলিশ হটলাইনে ফোন করে ‘অবাধ্য’ প্রতিবেশী বা সহকর্মীদের বিষয়ে তথ্য দিচ্ছেন।

শিক্ষকদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে শিক্ষার্থীদেরকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে হবে ৪৮ ভলিউমের বই পড়িয়ে- যার নাম ‘মাই হোম ইজ ইন চায়না’। গণগ্রন্থাগারগুলো থেকে অনেক বই সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, যেগুলোর মধ্যে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র এবং নেলসন ম্যান্ডেলার ওপর লেখা বইও রয়েছে। নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছে, ১৯৯৭ সালে হংকংকে চীনের কাছে হস্তান্তরের সময় এই শহরে বাক স্বাধীনতা, সমাবেশ করার স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, যা চীনের মূল ভূখণ্ডে কল্পনাও করা যায় না। কিন্তু চীনের বর্তমান নেতা শি জিনপিংয়ের অধীনে, কমিউনিস্ট পার্টি হংকংয়ের এই ‘স্বাধীনচেতা’ পরিচয় আর বরদাস্ত করতে পারছে না।

২০১৯ সালে এখানকার জনগণ প্রায় বিদ্রোহ করতে বসেছিল, সরকারবিরোধী বিক্ষোভ ফুঁসে উঠেছিল। এখন, জাতীয় নিরাপত্তা আইনের সম্প্রসারিত বলয়ে বলীয়ান বেইজিং চেষ্টা করছে হংকংকে মূল ভূখণ্ডের অন্যান্য মেগাসিটির মত আরেকটি মেগাসিটি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে, একটি অর্থনৈতিক ইঞ্জিন বানাতে, যেখানে বিরোধিতাকে তাৎক্ষণিকভাবে মিটিয়ে দেওয়া যাবে। এ মাসে হংকংয়ে নিযুক্ত বেইজিংয়ের শীর্ষ কর্মকর্তা লুও হুইনিং বলেন, হংকংয়ের সব শ্রেণিপেশার মানুষ উপলব্ধি করেছে যে ‘এক দেশ’ ধারণাটি ‘দুই ব্যবস্থা’র পূর্বশর্ত ও ভিত্তি।

নিউ ইয়র্ক টাইমন লিখেছে, হংকং এখন অপরিচিত দৃশ্যাবলীর একটি মন্তাজ, অনেকের জন্যই ‘অস্বস্তিকর’। শহরের পুলিশ কর্মীরা এখন চীনের সামরিক বাহিনীর কায়দায় পা ফেলে, বদলে গেছে দশকের পর দশক ধরে চলে আসা ব্রিটিশ-ধারার কুচকাওয়াজ। সেখানকার নেতারা এখন নিয়মিতই ‘বহিঃশক্তির’ সমালোচনা করেন, দেশের স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে বলে গলা ফাটান। হংকংয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা সমবেত হয়ে, ডান হাত উঁচু করে দেশের প্রতি অনুগত থাকার শপথ নেন, যেভাবে চীনের মূল ভূখণ্ডের কর্মকর্তারা নিয়মিত শপথ নিয়ে থাকেন।

একে তারা বলেন ‘বিয়াও তাই’, যার অর্থ ‘নিজের অবস্থান ঘোষণা করা’। সাত বছরের সরকারি চাকরি করার পর সম্প্রতি এই শপথে স্বাক্ষর করার বিরোধিতা করে পদত্যাগ করেছেন এইচ ডব্লিউ লি। তিনি বলেন, এই স্বাক্ষর না করলে ভুগতে হবে বলে কর্মকর্তাদের হুমকি দেওয়া হয়েছে। তিনি শুনেছেন অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তাদের অধীনস্তদের চাপ দিয়ে লিখিত শপথে স্বাক্ষর করিয়েছেন। যেসব আইন সবাইকে সুরক্ষা দিয়ে আসছিল কর্মী ও নাগরিক হিসেবে- সেগুলো দুর্বল করা হচ্ছে। সমাজের অনেক প্রান্তেই আইনগুলো সম্পূর্ণ নতুন করে লেখা হয়েছে।

তবে হংকংয়ের প্রতি দেওয়া প্রতিশ্রুতিভঙ্গের অভিযোগ অস্বীকার করেছে বেইজিং, বরং দাবি করেছে তারা একে আরও সুসংহত করছে। চীন যখন হংকংয়ের নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার করল, তাদের প্রতি সম্ভাব্য অবাধ্যদের প্রার্থিতা বাতিলের জন্য, তখনও তারা বলেছিল, এই পরিবর্তন ‘হংকংয়ের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ‘নিখুঁত’ করে তুলছে। যখন প্রভাবশালী গণতন্ত্রপন্থি সংবাদপত্র অ্যাপল ডেইলি বন্ধ করে দেওয়া হল পুলিশের গ্রেপ্তার অভিযানের পর, তখনও পার্টির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে এই প্রকাশনাটি ‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অপব্যবহার করেছে’।

যখন বেশ কিছু বিরোধী রাজনৈতিক নেতা একটি অনানুষ্ঠানিক নির্বাচনী বাছাইয়ের আয়োজন করেছিল, চীনের কর্মকর্তারা তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অভিযোগ আনে এবং তাদের গ্রেপ্তার করে। চীনের ক্ষমতা এখন এতোটাই সুদূর প্রসারী যে হংকংয়ের একসময়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নায়ক চ্যান তাত চিং গত এক বছর ধরে তার বন্ধুদের আহ্বান জানিয়ে চলেছেন, যাতে তারা বেইজিংকে চ্যালেঞ্জ না করে। তবে, হংকং এখনও মূল ভূখণ্ডের আরেকটি চীনা-মহানগরীতে পরিণত হয়নি। এখানকার বাসিন্দারা প্রমাণ করে চলেছে, স্বাধীনতায় ছাড় দিতে তাদের চরম অনাগ্রহ, এবং কিছু অংশ শুধু হংকংয়ের পরিচয়কে তুলে ধরার জন্য প্রতীক সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে।

‘মেইড ইন হংকং’ লেখা মুখোশ রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। স্থানীয় ছেলেদের ব্যান্ড দল মিরর সেখানে ‘আশা ও অহংকারের’ প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে। হংকংবাসী আবার আগ্রহী হয়ে উঠেছে কান্তো-পপের প্রতি। গত গ্রীষ্মে, হংকংয়ের ব্যবসায়ী হারবার্ট চো বিক্ষোভের পতাকাধারী গ্যাস মাস্ক পরিহিত একটি সাত ফুট দীর্ঘ নারী বিক্ষোভকারীর প্রতিমূর্তি গড়েন। চিক্কিডাক নামের শিশুদের পোশাকের চেইন শপের মালিক চো। এই স্থাপনা ছাড়াও বিক্ষোভের বিভিন্ন সামগ্রী নিজের দোকানগুলোতে বিক্রি করতেন তিনি।

কিন্তু ৫৭ বছরের চো এখন তার বাড়িওয়ালাদের চাপের মুখে, তাদের অনেকেই এখন আর চোয়ের সঙ্গে ভাড়ার চুক্তি নবায়ন করতে চান না। গত বছর হংকংয়ে হারবার্ট চোয়ের চিক্কিডাকের ১৩টি দোকান ছিল, এখন মাত্র পাঁচটি চলছে। তিনি বলেন, তার শহর আর কতদিন বেজিংয়ের ‘লৌহমুষ্ঠিকে’ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় আছেন তিনি। ভয়- এটা আপনাকে শক্তিশালী করতে পারে, কারণ আপনি ভয়ে ভয়ে জীবন কাটাতে চান না। অথবা আপনি নিজের ভেতরের লড়াই করার ইচ্ছাটিকে মেরে ফেলতে পারেন।


আরোও অন্যান্য খবর
Paris