শুক্রবার

২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ইউএফও’ নিয়ে কী আছে আমেরিকার গোপন রিপোর্টে?

Paris
Update : শুক্রবার, ২৫ জুন, ২০২১

এফএনএস : ইউএফও- মানে ‘আনআইডেন্টিফায়েড ফ্লাইং অবজেক্টস’ বা অজ্ঞাত উড়ন্ত বস্তু। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, পৃথিবীর নানা দেশে নানা সময় আকাশে উড়তে দেখা গেছে এগুলোকে। বিচিত্র আকারের নভোযানের মত দেখতে এগুলো, অত্যন্ত দ্রুত গতিতে উড়ে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যায়। বৈমানিক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত বহু জন এই রহস্যময় উড়ন্ত যান দেখার কথা বলেছেন, কিন্তু অনেকেই তাদের বর্ণনা বিশ্বাস করেন না। এগুলো নিয়ে সিনেমা-টিভি ধারাবাহিক হয়েছে, কিন্তু এর রহস্যভেদ আজও হয়নি।

অনেকের ধারণা, এগুলো গোপন কোন সামরিক বিমানের পরীক্ষামূলক উড্ডয়ন, আবার কেউ বলেন এগুলো ভিনগ্রহ থেকে আসা বুদ্ধিমান প্রাণিদের নভোযান। আসলে এগুলো যে ঠিক কি- তা কেউই জানে না। অন্তত এখন পর্যন্ত। তবে এ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি রিপোর্ট প্রকাশ করতে যাচ্ছে মার্কিন সরকার, জুন মাস শেষ হবার আগেই। এ রিপোর্টটি এতদিন ক্লাসিফায়েড অর্থাৎ অতি গোপনীয় অবস্থায় ছিল। কিন্তু মার্কিন সামরিক বাহিনীর ভেতর থেকেই আকাশে ইউএফও দেখতে পাবার এত অসংখ্য রিপোর্ট এসেছে যে মার্কিন কংগ্রেস এই রিপোর্টটি চেয়ে পাঠিয়েছে।

অনেকে বলছেন, ইউএফওগুলো যে অন্য কোন গ্রহ থেকে এসেছে এমন মতবাদের পক্ষে নিশ্চিত প্রমাণ খুবই কম। তাই রিপোর্টটি প্রকাশ করলেও মানুষের ধারণায় কতটা পরিবর্তন আসবে- তা দেখার বিষয়। সামরিক নেতারা সতর্ক করে দিয়েছেন যে, এসব ইউএফওর যে প্রযুক্তি তা যদি অন্য কোন গ্রহের প্রাণীদের না-ও হয়, তা যুক্তরাষ্ট্রের বৈরি কোন দেশ- যেমন রাশিয়া বা চীনেরও হতে পারে। রিপোর্টটি সম্পর্কে আমরা কী জানি? গত বছরের আগস্ট মাসে মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতর বা পেন্টাগন একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করে- যার উদ্দেশ্য ছিল অজানা উড়ন্ত বস্তু দেখতে পাবার বিবরণগুলো পরীক্ষা করে দেখা।

এর নাম ছিল আনআইডেন্টিফায়েড এরিয়াল ফেনোমেনা টাস্ক ফোর্স। এর দায়িত্ব ছিল এসব ঘটনা ‘চিহ্নিত করা, বিশ্লেষণ ও তালিকাভুক্ত করা। তাছাড়া ইউএফও’র প্রকৃতি এবং উৎস সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করা। রিপোর্টটিতে গত দুই দশকের ১২০টি ইউএফও সংক্রান্ত ঘটনাকে বিশ্লেষণ করা হয়। এর মধ্যে ছিল তিনটি ভিডিও যা গত বছর পেন্টাগন ডি-ক্লাসিফাই করে অর্থাৎ আগে গোপন রাখা হয়েছিল এমন অবস্থা থেকে জনসমক্ষে প্রকাশ করে।

এই রিপোর্টের একটি গোপন সংস্করণ জুন মাসের প্রথম দিকে মার্কিন আইনপ্রণেতাদের হাতে দেয়া হয়। মার্কিন সংবাদমাধ্যমকে কিছু নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তা বলেছেন- রিপোর্টে বলা হয়েছে যে “ভিনগ্রহের মানুষের কর্মকাণ্ডের কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি, তবে এমন সম্ভাবনা বাতিল করেও দেয়া হয়নি।” এ ছাড়াও আরেকটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, এতে বলা হয়েছে যে “ইউএফওগুলো কোন গোপন মার্কিন সামরিক প্রযুক্তি নয়”।

কিন্তু তাহলে এই “অজ্ঞাত উড়ন্ত বস্তুগুলো” ঠিক কী- তা নিয়েও কোন সুনির্দিষ্ট কোন সিদ্ধান্তে পৌছাতে পারেনি ওই রিপোর্টটি। বলা হচ্ছে- এ রিপোর্ট থেকে কোন দুনিয়া-কাঁপানো রহস্য উদ্ঘাটন হবে না। তবে এ বিষয়ে যে একটি সরকারি রিপোর্ট প্রকাশ করা হচ্ছে- তাতেই বোঝা যায় যে ইউএফও ইস্যুটি কল্পবিজ্ঞান ও পপ-সংস্কৃতির জগৎ থেকে বেরিয়ে এসে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। কেন এটা গুরুত্বপূর্ণ? এই কথিত ভিনগ্রহের প্রাণীদের নভোযানে চড়ে পৃথিবীতে আসার তত্ত্ব নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে নানা যুক্তি দিয়ে আসছেন একদল লোক- যাদের বলা হয় ইউএফওলজিস্ট।

এরা বলেন, এই ইউএফও-র অস্তিত্বের অনেক প্রমাণ আছে, কিন্তু সরকার এগুলো দীর্ঘদিন ধরে ধামাচাপা দিয়ে রেখেছে। এ কারণে সরকারের ওপর চাপ বাড়ছিল- যেন তারা কথিত ভিনগ্রহের প্রাণীদের সম্পর্কে কী জানে- তা প্রকাশ করে। আকাশপথে আসা সম্ভাব্য হুমকি চিহ্নিত করার লক্ষ্যে মার্কিন সামরিক বাহিনীর একটি কর্মসূচি আছে- যার সম্পর্কে লোকে খুব বেশি জানে না। এর নাম এ্যাডভান্সড এ্যারোস্পেস থ্রেট আইডেন্টিফিকেশন প্রোগ্রাম। এরই আওতায় পেন্টাগন ২০০৭ সাল থেকেই ইউএফও সম্পর্কে উপাত্ত সংগ্রহ করে আসছে।

নেভাদা অঙ্গরাজ্যের সেনেটর হ্যারি রীড এই প্রকল্পের জন্য অর্থের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। তিনি একজন ডেমোক্র্যাট এবং তার নির্বাচনী এলাকার ভেতরেই পড়ে একটি আলোচিত জায়গা- যার নাম এরিয়া ফিফটি ওয়ান। এরিয়া-৫১ হচ্ছে একটি সামরিক বাহিনীর জায়গা। ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকরা বিশ্বাস করেন, রসওয়েল নামে এটি শহরে একবার একটি ইউএফও বিধ্বস্ত হয়েছিল। সেটা থেকে পাওয়া নমুনাগুলো ১৯৪৭ সাল থেকেই পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে এই এরিয়া-৫১ এ। এ ব্যাপারে তথ্য প্রমাণ কী আছে? বেশ কিছু মার্কিন সামরিক ও গোয়েন্দা কর্মকর্তা ইউএফও দেখার ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন।

এর মধ্যে অধিকতর বিশ্বাসযোগ্য বর্ণনাগুলো এসেছে পাইলটদের কাছ থেকে। সামরিক অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের কাছাকাছি ইউএফও উড়ছে- এ দৃশ্য তারা ককপিট থেকেই দেখতে পেয়েছেন। মার্চ মাসে সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা পরিচালক জন র‌্যাটক্লিফ ফক্স নিউজকে বলেছিলেন, খবরে যতটুকু প্রকাশ করা হয় তার চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যক ইউএফও দেখা গেছে। “আমরা এমন সব বস্তুর কথা বলছি, যা নৌবাহিনী বা বিমানবাহিনীর পাইলটরা দেখেছে, অথবা যা উপগ্রহ চিত্রে ধরা পড়েছে। এগুলো এমন কাজ করে যা ব্যাখ্যা করা কঠিন।”- বলেন তিনি।

“এগুলো এমনভাবে চলাচল করে যা (উড়ন্ত বস্তুর পক্ষে) খুবই কঠিন, যেভাবে চলার মত প্রযুক্তি আমাদের নেই। এরা শব্দের চেয়ে দ্রুত গতিতে চলছে কিন্তু ‘সনিক বুমে’র মত কোন শব্দ হচ্ছে না।” গত মাসে সিবিএস নিউজের সিক্সটি মিনিটস অনুষ্ঠানে সাবেক দুজন নৌবাহিনীর পাইলট বর্ণনা করেন প্রশান্ত মহাসাগরের আকাশে একটি ইউএফও দেখার কথা। একজন পাইলট বর্ণনা করেন, জিনিসটা দেখতে ছিল মিন্ট বা টিক-ট্যাকের মত সাদা রঙের ছোট একটা বস্তু। সাবেক নেভি পাইলট এ্যালেক্স ডিয়েট্রিখ বিবিসিকে বলেন, “জিনিসটা ঠিক টিক-ট্যাকের মতই দেখতে, কিন্তু এটা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে কিন্তু পাগলের মত এদিক-সেদিক ছুটোছুটি করছিল।

আমরা বুঝতে পারছিলাম না- এটা কোনদিকে যাবে, কী করবে, অথবা কী পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে জিনিসটা এমনভাবে উড়তে পারছে। এর কোন ধোঁয়া ছিল না বা একে পরিচালনার জন্য কোন ইঞ্জিনও দেখা যাচ্ছিল না। এটা যেভাবে বাঁক নিচ্ছিল, সেভাবে চলতে হলে যে ফ্লাইট কন্ট্রোল দরকার, সেরকম কিছুও ছিল না।” ইউএফও’র ব্যাপারে অন্য দেশগুলো কী করছে? সাবেক সেনেটর রীড ইউএফও কর্র্মসূচির জন্য ২ কোটি ২০ লাখ ডলার পেয়েছেন। তিনি বলছেন, চীনও এখন ইউএফও নিয়ে গবেষণা করছে।

মি. রীড ২০১৯ সালে নেভাদা নিউজমেকার্সকে বলেছিলেন, “আমরা জানি যে চীন এ নিয়ে কাজ করছে। আমরা জানি যে রাশিয়াও এ নিয়ে কাজ করছে এবং এর নেতৃত্ব দিচ্ছে কেজিবির ভেতরে থাকা কেউ একজন। তাই আমাদের নিজেদের ভালোর জন্যই এ ব্যাপারটার দিকে তাকানো দরকার।” তিনি বলছেন, মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতরের গবেষণায় বলা হচ্ছে যে একজন দু-জন নয়, ১০-২০ জনও নয়, শত শত লোক আকাশে এসব ইউএফও দেখেছে, কখনো কখনো সবাই একসঙ্গে দেখতে পেয়েছে। ভিনগ্রহের সাথে সম্পাদিত একটি চুক্তি? গত ডিসেম্বর মাসে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন মহাকাশ দফতরের সাবেক প্রধান হাইম এশেদ স্থানীয় একটি সংবাদপত্রকে সাক্ষাতকার দিয়েছিলেন।

তিনি বলেছিলেন, মি. ট্রাম্প “ভিনগ্রহের সাথে সম্পাদিত একটি চুক্তির অস্তিত্ব” প্রকাশ করার কাছাকাছি চলে এসেছিলেন, কিন্তু মানুষের মধ্যে এ নিয়ে বেশি হৈচৈ পড়ে যাবে- এই ভয়ে শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে আসেন। “মার্কিন সরকার এবং ভিনগ্রহের প্রাণীদের মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছে। তারা এখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর জন্য একটি চুক্তি সই করেছে,” – ইয়েদিওত আহারোনত পত্রিকাকে বলেন তিনি। এই বিবৃতি অবশ্য মানুষ বা ভিনগ্রহের প্রাণী- কেউই নিশ্চিত করেনি। মার্কিন রাজনীতির শীর্ষ ব্যক্তিরাও কৌতুহলী।

এ নিয়ে ইউএফও’র পেছনে আসল সত্যটা কী- তা নিয়ে কথা বলেছেন শীর্ষ মার্কিন কর্মকর্তা, এমনকি প্রেসিডেন্টরাও। হিলারি ক্লিনটনের প্রচারাভিযানের ম্যানেজার জন পোডেস্ট দীর্ঘদিন ধরেই ইউএফও-র ব্যাপারে অত্যন্ত আগ্রহী। ২০১৬ সালে নির্বাচনের আগে তিনি অঙ্গীকার করেছিলেন যে, হিলারি ক্লিনটন প্রেসিডেন্ট হলে তিনি ভিনগ্রহের মানুষ সম্পর্কে গোপন সরকারি রিপোর্টগুলো প্রকাশ করবেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত বছর এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, এলিয়েন বা কথিত ভিনগ্রহের প্রাণীদের ব্যাপারে তিনি যা জানেন- তা তিনি তার পরিবারের কাছেও প্রকাশ করবেন না।

তিনি বলেছিলেন, “আমি যা জানি তা নিয়ে আপনাদের সাথে কথা বলবো না, তবে ব্যাপারটা খুবই ইন্টারেস্টিং।” সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা মে মাসে এক টিভি অনুষ্ঠানে বলেন, “আমি দায়িত্ব গ্রহণের পর জিজ্ঞেস করেছিলাম, এমন কোন ল্যাবরেটরি কি আছে যেখানে আমরা ভিনগ্রহের প্রাণী ও তাদের স্পেসশিপের নমুনা রেখেছি? তারা কিছু খোঁজখবর নিলো, তার পর জানালো, ‘না’।” তবে মি. ওবামা বলেন, “যেটা সত্যি তা হলো, আমি সিরিয়াস ভাবেই বলছি যে আকাশে উড়ন্ত কিছু বস্তুর ভিডিও ফুটেজ আছে কিন্তু সেগুলো কী- তা আমরা জানি না।

আমরা ব্যাখ্যা করতে পারছি না যে কীভাবে এগুলো ওড়ে, তাই এগুলো কী- তা বের করার জন্য গুরুত্ব দিয়ে চেষ্টা করা উচিত,”- বলেন মি. ওবামা। মার্কিন কংগ্রেসে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান উভয় শিবিরেরই এমন সদস্যরা আছেন যারা মনে করেন, এ ব্যাপারে গোপন রিপোর্টটি প্রকাশ করা হলে মার্কিন সৈন্যরা ব্যাখ্যাতীত কিছু দেখতে পেলে তা সিনিয়র অফিসারের কাছে- তা বলতে দ্বিধা করবেন না।


আরোও অন্যান্য খবর
Paris