শুক্রবার

১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মহামারীতেও সরকারি চাকরিজীবীরা ব্যাপক হারে ফ্ল্যাট-প্লট কেনায় আবাসন খাতে জমজমাট অবস্থা

Paris
Update : বুধবার, ২৩ জুন, ২০২১

এফএনএস : করোনা মহামারীতেও দেশের আবাসন খাতে চাঙ্গা ভাব বিরাজ করছে। বিদ্যমান মহামারীতে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ব্যাপক হারে প্লট-ফ্ল্যাট কিনেছে সরকারি চাকরিজীবীরা। মূলত সরকারের দেয়া ঋণ ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগিয়ে তারা ফ্ল্যাট ও প্লট কিনছে। কারণ সরকারি চাকুরেদের ৭০-৭৫ লাখ টাকা পর্যন্ত গৃহঋণ সুবিধা দেয়া হয়েছে। যা জমি ও ফ্ল্যাটের ব্যবসা সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে।

তাছাড়া গত বছর ঘোষিত করবহির্ভূত আয় বিনিয়োগের অনুমোদনও আবাসন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ওই সুযোগ ঘোষণার পর আবাসন খাতে ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকারও বেশি করমুক্ত বিনিয়োগ এসেছে। তাছাড়া গৃহঋণে ৯ শতাংশ সুদ, জমি হস্তান্তরে করহার ২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করা এবং স্ট্যাম্প ডিউটি ৩ শতাংশ থেকে কমিয়ে দেড় শতাংশ করার মতো পদক্ষেপগুলোও আবাসন খাকেতর সম্প্রসারণে ভূমিকা রাখছে। আবাসন খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, মহামারীর আগে গত বছরের শুরুতেও আবাসন খাত বেশ জমজমাট ছিল। তবে মহামারীর ধাক্কায় কিছুদিন আবাসন খাতের ব্যবসায় কিছুটা ধীর গতি নেমে এলেও সরকারি সুযোগ-সুবিধা ও ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নয়ন কাজে লাগিয়ে আবাসন খাতের বাজার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। গত বছরের মধ্যভাগের পর থেকেই খাতটিতে বিনিয়োগ বাড়তে থাকে। বর্তমানে মহামারীর নতুন প্রবাহ ও লকডাউনের মধ্যেও ওই ধারা অব্যাহত রয়েছে। মূলত বিগত ২০২০ সালের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই আবাসন খাত জমজমাট হতে শুরু করে। জমি ক্রয়ে ব্যাপক চাহিদা দেখা যায়।

এমনকি বছরটি শেষ হতে হতেই জমির চাহিদা বেড়ে শুরুর তুলনায় ১০ গুণে দাঁড়ায়। কারণ প্রপার্টির চেয়ে জমিতে বিনিয়োগে মুনাফা বেশি। ফলে ওই সময়ে জমির চাহিদাও ছিল বেশি। সেক্ষেত্রে ঢাকার বাইরে, বিশেষ করে পূর্বাচলের মতো এলাকাগুলোয় জমির দাম এখনো অনেকটাই গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে রয়েছে। তবে সেখানেও তা দ্রুত হারে বাড়ছে। ফলে ওসব এলাকায় জমি কেনায় অনেকেই আগ্রহ দেখাচ্ছে। এ ধারা চলতি বছরেও অব্যাহত রয়েছে। আবাসন ব্যবসায়ীদের মতে, কভিডের প্রভাব কাটলে সাধারণ মানুষও জমিতে বিনিয়োগ শুরু করবে।

সূত্র জানায়, মহামারীর ধাক্কা কাটিয়ে আবাসন খাতের পরিস্থিতি এখন প্রাক-কভিড পর্যায়ে ফিরে এসেছে। কভিডের আগে অনেক ডেভেলপারই ফ্ল্যাট বিক্রির ওপর মূলধনি তহবিল সংগ্রহে বেশি নির্ভরশীল ছিল। মহামারীতে ক্রেতার সংখ্যা হ্রাস তাদের তারল্য সংকটে ফেলে দেয়। চাহিদা কমে যাওয়ায় আবাসন কোম্পানিগুলোও অ্যাপার্টমেন্টের দাম উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমিয়ে আনতে বাধ্য হয়। যদিও ফ্ল্যাটের দাম এখনো মহামারীর পূর্বাবস্থায় আসেনি।

তবে এমন পরিস্থিতিকে সম্ভাবনা হিসেবেও দেখছে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। তাদের মতে, দাম কমে যাওয়ায় আবাসন খাতে এখন বিনিয়োগের এক নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। কারণ অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যতে প্রপার্টির দামও বাড়বে। সূত্র আরো জানায়, আবাসন খাতে বর্তমানে যারা নিরাপদ বিনিয়োগ করতে চাচ্ছে ও করছে তারাই বড় ক্রেতা। তাদের মধ্যে সরকারি চাকরিজীবী ছাড়া ব্যবসায়ীরাও রয়েছে। পেশাজীবীদের মধ্যে আরেক ধরনের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, যারা স্বল্পমূল্যে ও ছোট আকারের বিলাসী আবাসন চাচ্ছে।

বর্তমানে স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টেরও বেশ চাহিদা বেড়েছে। মূলত কর্মজীবী দম্পতিদের মধ্যেই এ প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে। আর চাহিদা বৃদ্ধিতে সরকারি চাকরিজীবীরা বড় ভূমিকা রাখছে। কারণ তারা ঋণ সুবিধা নিতে পারছে। সরকারি কর্মকর্তারা ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ পাচ্ছে। ফলে তারা ওই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে। এ ধরনের ক্রেতাদের ভালো আগ্রহ আছে। তবে শুধু তারাই নয়, ক্রেতাদের মধ্যে আরো নানা পেশার লোক আছে। সেজন্যই বাজারে ৭০-৮০ লাখ টাকার ফ্ল্যাটগুলোর বেশ চাহিদা রয়েছে।

এদিকে দেশের আবাসন খাতের জন্য সবচেয়ে ভালো সময় ছিল গত দশকের শেষ ভাগ। ২০১০ সালে ফ্ল্যাটের দাম সর্বোচ্চে উঠেছিল। তারপর ওই খাতে হঠাৎ ধস নামে। দীর্ঘ সময়জুড়ে মন্দায় থাকা আবাসন খাতকে টেনে তুলতে সরকার বেশকিছু নীতিসহায়তা দিয়েছে। যার প্রভাবে এক দশক পর আবাসন খাতে আবারো মূল্যবৃদ্ধিতে উল্লম্ফনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। ফলে ক্ষেত্রবিশেষে করোনার মধ্যেও আবাসনের চাহিদা বেড়েছে। বিগত ২০১০ সালে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় ফ্ল্যাটের দাম বর্গফুটপ্রতি ৭ হাজার টাকা ছিল।

চাহিদার নিম্নমুখিতায় কভিডের আগেও সেখানে একই দামে ফ্ল্যাট কেনাবেচা হয়। তবে বর্তমানে ওই এলাকায় প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাটের দাম ৯ হাজার টাকায় উন্নীত হয়েছে। শুধু মোহাম্মদপুর নয়, রাজধানীর সব এলাকায়ই কম-বেশি ফ্ল্যাটের দাম বাড়তে শুরু করেছে। কলাবাগান এলাকায় প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাটের দাম ২০১০ সালে ছিল ৭ হাজার টাকা। প্রাক-কভিডকালেও ওই দামে কোনো পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু বর্তমানে প্রতি বর্গফুটের দাম ৯ হাজার ৫০০ টাকায় উন্নীত হয়েছে।

তাছাড়া রাজধানীর অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত বনানীতে প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাটের দাম ২০১০ সালে ছিল ১৩ হাজার টাকা। কভিডের আগে তা কমে ১১ হাজার টাকায় নেমে আসে। বর্তমানে দাম বেড়ে প্রতি বর্গফুট ১৩ হাজার ৫০০ টাকায় উন্নীত হয়েছে। একইভাবে কভিড-পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় ফ্ল্যাটের দাম বেড়েছে ধানমন্ডি, গুলশান, বারিধারা, লালমাটিয়া, মিরপুর, উত্তরা, শ্যামলী, কলাবাগান ও শান্তিনগর এলাকায়। রাজধানীর ওই ১১টি এলাকার গড় দাম বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০০৫ সালে ফ্ল্যাটের গড় মূল্য ছিল বর্গফুটপ্রতি ৩ হাজার ৬৪ টাকা। ২০১০ সালে এই দাম বেড়ে হয় ৯ হাজার ৫০০ টাকা। কভিডের আগে তা কমে গিয়ে ৯ হাজার ৯১ টাকায় ঠেকেছিল। ২০২০ সালের শেষ দিকে ওই দাম আবার বেড়ে প্রতি বর্গফুট ১১ হাজার ৪৫৫ টাকায় দাঁড়ায়।

অন্যদিকে আবাসন খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, কভিডের শুরুর দিকে আবাসন খাতে কিছুটা মন্দা ভাব ছিল। কিন্তু ২০২০ সালের জুলাই-আগস্টের পর থেকে পরিস্থিতি ভালো হতে শুরু করে। ওই সময় থেকেই দেশের গোটা আবাসন খাতেই ইতিবাচক ধারা দেখা গেছে। বর্তমান আবাসন চাহিদা কভিডের পূর্ব অবস্থায় ফিরে গেছে। অবশ্য েেক্ষত্রে সরকারি চাকুরেদের ঋণ সুবিধা বড় ভূমিকা রাখছে। ক্রেতারা ৩-৪ জন মিলে জমি বা প্রপার্টি কিনতে পারছে। স্বাভাবিকভাবেই এটা একটা বড় প্রভাবক। তাছাড়া বাজারে তারল্য প্রবাহও ভালো। প্রচুর নির্মাণ ও উন্নয়ন কাজ হচ্ছে।

দেশের জনগোষ্ঠী সামান্য সঞ্চয় হলেই প্রপার্টি কেনার প্রতি আগ্রহী হচ্ছে। এখন ফ্ল্যাট-প্লটের মূল্য গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে থাকায় মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। ফলে সার্বিকভাবে আবাসন খাতের ব্যবসা যতোটা হওয়ার কথা ছিল ততটা খারাপ হয়নি। তবে চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সরবরাহ না থাকার কারণে সামনের দিনগুলোতে ফ্ল্যাট-প্লটের দামও কিছুটা বাড়তে পারে। কারণ গত দেড় বছরে কোনো নতুন প্রকল্প দেখা যায়নি।

এ প্রসঙ্গে আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন রিহ্যাব সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন জানান, বর্তমানে আবাসন খাতে যে চাহিদা বৃদ্ধি অন্যতম কারণ হচ্ছে সরকারি লোন ফ্যাসিলিটির পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর হোম লোনের ব্যবস্থা। সরকারি ঋণ সুবিধা চাহিদা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। তবে সরকারি কর্মকর্তাদের যে পরিমাণ ঋণ দেয়া হয় তা ১ হাজার ২০০, ১ হাজার ৩০০ বা ১ হাজার ৫০০ বর্গফুট ফ্ল্যাটের জন্য যথেষ্ট নয়। সরকার যদি ঋণ সুবিধা বাড়ায় তাহলে আবাসন বাজার পরিস্থিতি আরো ভালো হতো। বর্তমানে ফ্ল্যাটের দাম সংশোধন হওয়ার পর স্থিতিশীল আছে। এখন দাম আর নিচের দিকে যাচ্ছে না।


আরোও অন্যান্য খবর
Paris