শুক্রবার

২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

কোরবানির আগেই ৪ জেলায় চালু করা হচ্ছে কাঁচা চামড়ার মডেল সংরক্ষণাগার

Paris
Update : শনিবার, ১২ জুন, ২০২১

এফএনএস : প্রতি বছরই বিপুল পরিমাণ কোরবানীর পশুর চামড়া নষ্ট হওয়ায় প্রান্তিক ব্যবসায়ীদের ব্যাপক আর্থিক লোকসানের মুখে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষ থেকে এবার আসন্ন কোরবানীর কাঁচা চামড়া সংরক্ষণে ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে এবার কাঁচা চামড়ার ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতেও কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে এবং নির্ধারিত মূল্যে চামড়া বেচাকেনা, সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও মজুদে জোর দেয়া হবে।

করোনায় স্বাস্থ্যবিধি মেনেই পাঁচ মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে গঠিত কমপ্রেহেনসিভ মনিটরিং টিম কাঁচা চামড়া সংগ্রহের সমন্বয় করবে। আর দেশজুড়েই পর্যায়ক্রমে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে চামড়া সংরক্ষণে নির্মাণ করা হবে ৬০০টি গুদাম। তারই অংশ হিসেবে আসন্ন কোরবানির আগেই কাঁচা চামড়ার ‘হাব’ হিসেবে খ্যাত দেশের ৪ জেলায় মডেল সংরক্ষণাগার (গুদাম) চালু করা হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং চামড়া শিল্প খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, এদেশে প্রতি বছর এক কোটি ২৫ লাখ পশু কোরবানি করা হয়। কিন্তু এক শ্রেণীর ব্যবসায়ীর কারসাজিতে কয়েক বছর ধরেই এতো বিপুল পরিমাণ চামড়া নিয়ে সঙ্কট তৈরি হচ্ছে। ওই অসাধু ব্যবসায়ীরা তখন নানা অজুহাতে চামড়া ক্রয় বন্ধ করে দেয়। তাতে গ্রাম-গঞ্জে সরকার নির্ধারিত মূল্যে চামড়া সংগ্রহ করে প্রান্তিক ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়ে। অসাধু ব্যবসায়ীরা মূলত কম দামে প্রান্তিক ব্যবসায়ীদের তাদের কাছে চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য করার জন্যই কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে। ফলে প্রতি বছরই প্রান্তিক ব্যবসায়ীদের লোকসানের পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ চামড়া নষ্ট হয়ে যায়।

এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সরকার ‘কমিউনিটি পর্যায়ে প্রান্তিক ক্ষুদ্র চামড়া ব্যবসায়ীদের জন্য চামড়া সংরক্ষণাগার’-শীর্ষক একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। ওই প্রকল্পের আওতায় সারাদেশে ৬০০টি চামড়া সংরক্ষণাগার নির্মাণ করা হবে। আর পাইলট প্রকল্প হিসেবে এবার কোরবানির ঈদের আগেই চামড়ার ‘হাব’ হিসেবে খ্যাত দেশের ৪টি জেলায় ৪টি সংরক্ষণাগার চালু হবে। আর পুরো প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে দেশে কাঁচা চামড়া নিয়ে কয়েক দশকের পুরনো সঙ্কটের সমাধান হবে এবং ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট বাণিজ্যও বন্ধ হবে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়া খাতের রফতানি বাণিজ্যেও উজ্জ্বল ভাবমূর্তি তৈরি হবে।

সূত্র জানায়, কাঁচা চামড়ার হাব হিসেবে খ্যাত ঢাকার সাভার, উত্তরবঙ্গের নাটোর, বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম এবং কুষ্টিয়ায় পাইলট প্রকল্পের ৪টি গুদাম নির্মিত হচ্ছে। আর ঢাকার সাভারে চামড়া শিল্পনগরী পুরোদমে উৎপাদনে যাওয়ায় রাজশাহীতে আরেকটি গুদাম করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। কোরবানির আগেই গুদামগুলো চালু করা হবে। চামড়া আহরণের পরিমাণ বিবেচনায় নিয়ে সারাদেশে তিন আকারের গুদাম নির্মাণ করা হবে। বড় আকারের গুদাম হবে ৪০টি, মাঝারি মানের ৫০টি এবং ৫১০টি ছোট আকারের গুদাম নির্মাণ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। কোরবানির চামড়া সংরক্ষণে সরকার গত বছর কমপ্রেহেনসিভ মনিটরিং প্ল্যান তৈরি করেছে।

পাঁচ মন্ত্রণালয় ও আরো কয়েকটি অধিদফতরের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ কমিটি এবারও কাঁচা চামড়া সংরক্ষণ ও মজুদের বিষয়টি পর্যবেক্ষণ এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। শিল্প, বাণিজ্য, পরিবেশ ও বন, ধর্ম ও তথ্য মন্ত্রণালয়, এনবিআর, অর্থ বিভাগ, ট্যারিফ কমিশন, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং চামড়াশিল্প সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিরা ওই কমিটিতে কাজ করবে। তাছাড়া লবণের সরবরাহ ও মূল্য পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণসহ সাপ্লাই চেইন স্বাভাবিক রাখতেও বিশেষ নজর দেয়া হবে। শিগগিরই এ সংক্রান্ত একটি বৈঠক হতে যাচ্ছে।

সূত্র আরো জানায়, চামড়া খাতের কিছু ব্যবসায়ী কয়েক বছর ধরেই কোরবানির চামড়ার দাম নিয়ে এক ধরনের অপকৌশল গ্রহণ করে আসছে। ওই অপকৌশলের কারণে মাঠপর্যায় থেকে ঠিকমতো চামড়া সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না। আর ন্যায্যদাম নিশ্চিত না হওয়ায় নদী-নালা, ডোবা, ড্রেন এবং মহাসড়কে চামড়া ফেলে দেয়া হয়। তাতে রফতানিতে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা চামড়া শিল্পের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। এমনকি বড় ক্রেতা দেশগুলো বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে। এমন পরিস্থিতি এড়াতেই সরকার ‘কমিউনিটি পর্যায়ে প্রান্তিক ক্ষুদ্র চামড়া ব্যবসায়ীদের জন্য চামড়া সংরক্ষণাগার’ প্রকল্প গ্রহণ করেছে।

চামড়া সংরক্ষণ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে আবারো এই খাত সুনামের সঙ্গে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাণিজ্য সম্প্রসারণ করতে পারবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। তাদের মতে, কমিউনিটি পর্যায়ে কোরবানির চামড়া সংরক্ষণের প্রকল্পটি পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলে সারাদেশে কাঁচা চামড়া নিয়ে আর কোন সঙ্কট তৈরি হবে না। আশা করা যায় এবার নির্ধারিত মূল্যে চামড়া বেচাকেনা হবে এবং চামড়া নিয়ে কোন কারসাজি হবে না। রফতানি বাণিজ্যে চামড়া একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। দেশে চামড়ার উৎপাদন ও বাণিজ্য বাড়ছে। যে কারণে এ খাতে নজরদারি বাড়াতে হবে। বাণিজ্যমন্ত্রী সম্প্রতি কাঁচা চামড়া সংরক্ষণ ও করণীয় নির্ধারণে সরকারের ভূমিকা শীর্ষক এক বৈঠকে দ্রুত প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন।

তারই ধারবাহিকতায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সরকারি-বেসরকারী খাতের অংশীদারিত্বের (পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ-পিপিপি) ভিত্তিতে প্রকল্পটি গ্রহণ করেছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সরকার সহায়তাকারী হিসেবে বেশি ভূমিকা রাখবে কিন্তু বেসরকারী খাতের ওপর গুদামগুলো নির্মাণ ও দেখভালের পুরো দায়-দায়িত্ব থাকবে। বেসরকারী খাতের উদ্যোক্তারা সরকারের সঙ্গে পিপিপির ভিত্তিতে প্রকল্পটিতে বিনিয়োগ করে লাভবান হবে। ওসব গুদামে প্রান্তিক পর্যায়ের ক্ষুদ্র ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা সেবার বিনিময়ে নির্দিষ্টহারে সার্ভিস চার্জ প্রদান করবে। তাতে করে সারাদেশে কাঁচা চামড়া সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে।

এদিকে কমিটিনিটি পর্যায়ে প্রান্তিক ক্ষুদ্র চামড়া ব্যবসায়ীদের জন্য চামড়া সংরক্ষণাগারের মাধ্যমে ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে নির্মিত গুদামে চামড়া সংরক্ষণে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। গুদামে লবণ দিয়ে চামড়া সংরক্ষণ করে ৩ মাস ধরে তা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করা হবে। তারপরও ভাল দাম না পেলে সরকার ওসব লবণ দেয়া চামড়া বিদেশে রফতানির সুযোগ দেবে। ওই প্রকল্প বাস্তবয়ন হলে চামড়া নিয়ে ব্যবসায়ীদের ছিনিমিনি খেলা বন্ধ হবে। আর প্রান্তিক ব্যবসায়ীদেরও আর চামড়া ফেলে দিয়ে মূল্যবান জাতীয় সম্পদ নষ্ট করতে হবে না। এই প্রকল্পে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের প্রশিক্ষণ, সঠিক পদ্ধতি মেনে পশু থেকে চামড়া ছাড়িয়ে নেয়া, নিয়ম মেনে লবণ দেয়া, বর্জ্য দ্রুত অপসারণ এবং স্থাস্থ্যবিধি রক্ষা করে চামড়া সংরক্ষণ করার প্রশিক্ষণও দেয়া হবে।

পুরো প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সর্বপ্রথম ফিজিবিলিটি স্টাডি করা হয়। প্রকল্পের আওতায় সরকারি উদ্যোগে জেলা, উপজেলা ও কোন কোন ক্ষেত্রে ইউনিয়ন পর্যায়ে গুদাম ও ছাউনি নির্মাণ করে দেয়া হবে। আর তাতে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা সহজে লবণযুক্ত চামড়া মজুদ ও সংরক্ষণ করতে পারবে এবং কোরবানি পরবর্তী সুবিধাজনক সময়ে চামড়াগুলো দরকষাকষির মাধ্যমে বিক্রি করতে পারবে। ফলে দেশের সর্বত্র কোরবানির চামড়ার ন্যায্যদাম নিশ্চিত হবে। তাতে চামড়া নিয়ে যে কোন নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব হবে। ইতিমধ্যে চামড়া শিল্প খাতের বিকাশে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে সাভারের হেমায়েতপুরের চামড়া শিল্পনগরী গড়ে উঠেছে।

হাজারীবাগ থেকে সাভারে দেশের ১৫৪টি ট্যানারি শিল্প স্থানান্তরিত হয়েছে। ট্যানারিগুলো পুরোদমে ক্রাস্ট ও ফিনিশড চামড়া উৎপাদন করছে। ওই চামড়ার ওপর ভিত্তি করে দেশে গড়ে উঠেছে জুতা, স্যান্ডেল, ব্যাগ, বেল্ট ও জ্যাকেটের মতো চামড়াজাত পণ্যসামগ্রীর কারখানা। ওসব পণ্য দেশীয় চাহিদার পাশাপাশি বিদেশে রফতানি করা হচ্ছে। তাছাড়া ক্রাস্ট ও ফিনিশড চামড়া ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি করা হয়। রূপকল্প-২০২১ সালের মধ্যে ৪৩ হাজার কোটি টাকার চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

কিন্তু করোনাসহ নানা সঙ্কটের কারণে চামড়া রফতানিতে তেমন সুবিধা হচ্ছে না। তবে এ সমস্যা শিগগিরই কেটে যাবে বলে ব্যবসায়ীরা আশাবাদী। দেশের অর্থনীতি, শিল্প, বাণিজ্য ও কর্মসংস্থানের স্বার্থে চামড়া শিল্প খাতের অবদান অনেক। সরাসরি চামড়া শিল্প খাতে ৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। আর ওই ৫ লাখ মানুষের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ২৫ লাখ মানুষের ভাগ্য জড়িত।

অন্যদিকে কাঁচা চামড়া সংরক্ষণের প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাই-বাছাই করে সমীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ফ্যাসিলিটেশন কোম্পানি (আইআইএফসি) ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। আইআইএফসি সরকারের একটি সুপরিচিত পরামর্শ দাতা সংস্থা, যা সরকারি ও বেসরকারি তথ্য সংগ্রহ, পিপিপি লেনদেন, গবেষণা, জরিপ, আর্থিক ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত সহায়তা পরিষেবা সরবরাহ করে থাকে। ইতিমধ্যে আইআইএফসি চামড়া সংরক্ষণের প্রকল্প বাস্তবায়নে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উর্ধতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে একটি বৈঠক করেছে।

ওই বৈঠকে আইআইএফসির পক্ষ থেকে দেশের চামড়া শিল্প বিকাশে এমন ধরনের প্রকল্পটি দ্রত বাস্তবায়ন হওয়া প্রয়োজন বলে জানানো হয়। আর পুরো প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। আর চামড়া সংরক্ষণ প্রকল্পটি গ্রহণ করা সঠিক ও সময়োপযোগী প্রকল্প বলে মত দিয়েছেন বুয়েটের প্রতিনিধিরা। তাদের মতে, শিল্প বিকাশ ও রফতানি খাত শক্তিশালী করতে চামড়া সংরক্ষণ প্রকল্পটির একটি মূল্য রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ট্যানারি এ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) চেয়ারম্যান মোঃ শাহীন আহমেদ জানান, চামড়া সংরক্ষণের পাশাপাশি এ খাতের কমপ্লায়েন্স বেশি জরুরি। ট্যানারি শিল্পের মূল চ্যালেঞ্জ হলো কমপ্লায়েন্স। চামড়া শিল্পনগরীর প্রকল্পের মেয়াদ বারবার বৃদ্ধি করা হলেও এখনো কাজ অসম্পন্ন রয়েছে। শিল্পনগরী কমপ্লায়েন্ট না হওয়ায় বিদেশি ক্রেতারা আসছে না। যে কারণে দ্রুত কমপ্লায়েন্ট করতে সরকারি সহযোগিতা বাড়ানো জরুরি। চামড়া শিল্প বাঁচাতে কাঁচা চামড়া সংরক্ষণ করতে হবে। কারণ কাঁচা চামড়া ছাড়া এই শিল্প খাত টিকবে না।


আরোও অন্যান্য খবর
Paris