শনিবার

২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ভিটামিন এ প্লাস ক্যাম্পেইন

Paris
Update : শুক্রবার, ১১ জুন, ২০২১

মোঃ তৌহিদুজ্জামান : নানা উপলক্ষে পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষেরা নানাভাবে উৎসবে মেতে ওঠেন। তবে ‘স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্রিক দেশব্যাপী উৎসবের আমেজ’ এমনটা কল্পনা করা অনেকের পক্ষেই অসম্ভব, যদি তিনি বাংলাদেশে অবস্থান না করেন। হ্যাঁ, আমি বাংলাদেশের ভিটামিন এ প্লাস ক্যাম্পেইনের কথাই বলছি।

৬ মাস থেকে ৫ বছর বয়সী সকল শিশুকে একই দিনে ভিটামিন এ ক্যাপসুল খাওয়ানোর সরকারি মহাকর্মযজ্ঞ এবং আপামর জনসাধারণের আগ্রহ উদ্দীপনায় এদিনটি রীতিমত উৎসবে রূপ নেয়। অবশ্য করোনা অতিমারির বাস্তবতায়, গত বছরের দ্বিতীয় রাউণ্ডের মত এবছরও ভিটামিন এ প্লাস ক্যাম্পেইনটি এক দিনে না হয়ে বরং দুই সপ্তাহ ধরে বাস্তবায়িত হচ্ছে।

বাংলাদেশের অসংখ্য সফল কর্মসূচির ন্যায় শিশুদের ভিটামিন এ ক্যাপসুল খাওয়ানো কর্মসূচিরও সূচনা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই । ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু যখন জাতীয় রাতকানা প্রতিরোধ প্রকল্প শুরু করেন, তখনকার তথ্য মতে দেশে ৫ বছরের কম বয়সী ৪.১% শিশু রাতকানা রোগে আক্রান্ত ছিল। উক্ত প্রকল্পের মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিশুদের ভিটামিন এ ক্যাপসুল খাওয়ানো শুরু হয়।

রাতকানা রোগ প্রতিরোধ ছাড়াও আমাদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য ভিটামিন এ নামক অনুপুষ্টির প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। ভিটামিন এ শিশুর অপুষ্টি দূর করে এবং দেহের স্বাভাবিক বৃদ্ধি নিশ্চিত করে। এ অনুপুষ্টির অভাবে শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, ফলশ্রুতিতে তারা নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, আমাশয়, কলেরা এবং টাইফয়েডের মত রোগে ঘনঘন আক্রান্ত হয়।

ভিটামিন এ হাম, নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়াজনিত মৃত্যু হার হ্রাসসহ আরও অনেক ধরনের মৃত্যুহার হ্রাস করে। অনেকগুলো কারণে আমাদের দেশে শিশুদের দেহে ভিটামিন এ এর ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। কারো কারো ক্ষেত্রে ভিটামিন এ সমৃদ্ধ খাবার ক্রয়ে অক্ষমতা প্রধান কারণ সে বিষয়ে কোনও সন্ধেহ নেই। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিভাবকদের ভিটামিন এ এর প্রয়োজনীয়তা ও এর উৎস বিষয়ক জ্ঞানের অভাবেই মূখ্যত দায়ী।

অজ্ঞতার কারণে অনেকেই শিশুকে পর্যাপ্ত ভিটামিন এ সমৃদ্ধ খাবার প্রদান করে না। জন্মের পর শিশুকে শালদুধ না খাওয়ানো এবং নিয়মিত ও পর্যাপ্ত পরিমাণে মায়ের দুধ না খাওয়ানোও শিশুর ভিটামিন এ স্বল্পতার একটি বড় কারণ।

বর্তমানে বাংলাদেশে রাতকানা রোগ প্রায় নেই বললেই চলে। কিন্ত ২০১১-২০১২ সালের একটি জরিপে দেখা যায় যে, এদেশে ৫ বছরের কম বয়সী ২১ শতাংশ শিশু ভিটামিন এ এর অভাবজনিত সমস্যায় ভুগছে। ভিটামিন এ এর এরূপ ঘাটতি রেখে ‘সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ’ নামক টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের শিশু মৃত্যু হার কমানোর লক্ষমাত্রা অর্জন একটি অলীক কল্পনা। সে বাস্তবতায় সরকার দীর্ঘদিন ধরেই ভিটামিন এ প্লাস ক্যাম্পেইন অব্যাহত রেখেছে।

ভিটামিন এ ৪-৬ মাস যাবত যকৃতে জমা থাকে এবং দেহের প্রয়োজন অনুসারে তা ব্যবহৃত হয়। সে কারণে সরকার ৬ মাস অন্তর বছরে দুই বার করে এই ক্যাম্পেইন এর আয়োজন করছে। এ সময় ৬ থেকে ১১ মাস বয়সী শিশুকে একটি নীল রঙের এবং ১ থেকে ৫ বছর বয়সী শিশুকে একটি লাল রঙের ভিটামিন এ ক্যাপসুল দেওয়া হচ্ছে।

সম্পূরক ক্যাপসুল খাওয়ানোর সাথে সাথে অভিভাবককে পুষ্টি বার্তা দিয়ে খাবারের মাধ্যমেই শিশুর ভিটামিন এ এর ঘাটতি পূরণ এই ক্যাম্পেইনের অন্যতম লক্ষ্য। এ জন্য ক্যাম্পেইনের নামকরণ করা হয়েছে এ প্লাস ক্যাম্পেইন।

আমরা জানি, দুধ, ডিম, মাংস, কলিজা ও ছোট মাছ ভিটামিন এ এর প্রাণিজ উৎস আর উদ্ভিজ্জ উৎস হচ্ছে গাঁজর, মিষ্টি আলু, মিষ্টি কুমড়া, লাল শাক, পাকা আম, পাকা কাঁঠাল, পাকা পেঁপের মত গাঢ় ফল ও সবজি। প্লাস অংশে মূলত ভিটামিন এ খেতে আসা শিশুর অভিাবককে এই উৎসগুলো সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয় এবং সেগুলি শিশুকে খাওয়ানোর জন্য তাদেরকে উৎসাহিত করা হয়।

দেশে ভিটামিন এ প্লাস ক্যাম্পেইনের সুফল বেশ আগে থেকেই নিশ্চিত হওয়া গেছে। বর্তমানে দেশে রাতকানা রোগে আক্রান্তের হার ০.০৪%। আর বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার এক জরিপের ফলাফল বলছে, বছরে দুবার সম্পূরক ভিটামিন এ দেওয়ার ফলে ৬ মাস থেকে ৫ বছর বয়সী শিশুদের সব ধরনের মৃত্যু ২৪% , হাম জনিত মৃত্যু ৫০% এবং ডায়রিয়া জনিত মৃত্যু ৩৩% হ্রাস পেয়েছে।

আর একটি গবেষণায় দেখা গেছে, এরূপ ভিটামিন এ সম্পূরণ প্রতি ১০ লাখ শিশুর মধ্যে ৪ হাজার জনকে খর্বতা থেকে মুক্ত করে। ভিটামিন এ প্লাস ক্যাম্পেইনে সরকারের সাফল্য ঈর্ষণীয়। সাম্প্রতিক কয়েকটি ক্যাম্পেইনে কভারেজ ৯৯% এ পৌঁছেছে। অর্থাৎ প্রতি ১০০ জন শিশুর মধ্যে ৯৯ জনকেই ভিটামিন এ ক্যাপসুল খাওয়ানো সম্ভব হয়েছে। কিন্তু আমাদের লক্ষ্যমাত্রা যখন ২ কোটির বেশি, তখন ১% শিশু বাদ পড়া মানে ২ লাখের বেশি শিশু ভিটামিন এ থেকে বঞ্চিত থাকছে।

বাদ পড়াদের তথ্য সংগ্রহকালে দেখা যায়, অভিভাবকদের উদাসীনতাই বাদপড়া শিশুগুলোর ভিটামিন এ থেকে বঞ্চিত হওয়ার প্রধান কারণ। এবার ভিটামিন এ প্লাস ক্যাম্পেইন শুরু হয়েছে ৫ জুন এবং চলবে ১৯ জুন। করোনা আবহে ভিটামিন এ ক্যাম্পেইনে সরকার এবার বাড়তি সতর্ক। স্বাস্থ্য বিধি নিশ্চিত করতে এক দিনের ক্যাম্পেইন ১৪ দিন ধরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

সুস্বাস্থ্য শিশুর অধিকার, তাই সুস্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য ভিটামিন এ ক্যাপসুলও শিশুর অধিকার। একটি উন্নত প্রজন্ম গড়ার প্রত্যয়ে, আসুন আমরা আমাদের শিশুদেরকে ভিটামিন এ ক্যাপসুল খাওয়ানো নিশ্চিত করি, শিশু মৃত্যু রোধ করি। লেখক পরিচিতি : উপপ্রধান তথ্য অফিসার, আঞ্চলিক তথ্য অফিস, রাজশাহী।


আরোও অন্যান্য খবর
Paris