শুক্রবার

২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নিরপরাধদের সাজা খাটার ঘটনা গণমাধ্যমে আসা উচিত: হাইকোর্ট

Paris
Update : মঙ্গলবার, ৮ জুন, ২০২১

এফএনএস : চট্টগ্রামের একটি হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি কুলসুম আক্তার ওরফে কুলসুমির পরিবর্তে জেল খাটা নিরপরাধ মিনুকে মুক্তি দিতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। পাশাপাশি মূল আসামি কুলসুমকে দ্রুত গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একইসঙ্গে কুলসুমের স্বাক্ষর জালিয়াতি করে যারা হাইকোর্টে জামিন আবেদন করেছেন সেই আইনজীবী ও তদবিরকারীদের তলব করেছেন আদালত। আগামী ২৮ জুন হাইকোর্টে হাজির হয়ে এ বিষয়ে উপযুক্ত ব্যাখ্যাসহ জবাব দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মিনুর জেল খাটার বিষয়ে শুনানি নিয়ে গতকাল সোমবার হাইকোর্টের বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি মহিউদ্দিন শামীমের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চুয়াল বেঞ্চ এ আদেশ দেন।

শুনানির সময় আদালত বলেন, দেশে বিভিন্ন মামলায় অন্যের হয়ে কারাগারে সাজা খাটার মতো ঘটনাগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশ ও প্রচার হওয়া উচিত। আদালতে মিনুর পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মো. শিশির মনির। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ড. মো. বশির উল্লাহ। মামলার আদেশের পর হাইকোর্টে তারা বলেন, আমরা এ ধরনের ঘটনার রুট (মূল) খুঁজে বের করতে চাই।

আমরা মনে করি এসব ঘটনা মিডিয়ায় আসা উচিত, মানুষ যেন এমন কাজ আর করতে না পারে। এ সময় ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ড. মো. বশির উল্লাহ আদালতকে বলেন, এ ঘটনার সংবাদ সর্বোচ্চ প্রচার হবে। আমাদের কোর্টেও মিডিয়াকর্মীরা আছেন। এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনার মতো ফলোআপ পাবে। হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি কুলসুম আক্তারের হয়ে জেল খাটা মিনুর বিষয়টি আদালতের নজরে আনেন আইনজীবী শিশির মনির।

তার আবেদনের শুনানি নিয়ে হাইকোর্টের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ আইনজীবীকে এফিডেভিট দাখিল করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এরপর আদালতের এখতিয়ার পরিবর্তন হওয়ার বিষয়টি বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেনের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে শুনানির জন্য আসে। শুনানিতে জেলে থাকা নিরপরাধ মিনুর পুরো ঘটনা তুলে ধরে আইনজীবী শিশির মনির বলেন, বিগত দুই বছরে আমাদের দেশে এমন ২৬টি ঘটনা ঘটেছে। একজনের নামে আরেকজন জেলে থাকে। তিনি বলেন, আসল আসামি শনাক্তে অনেক পদ্ধতি আছে।

এ বিষয়ে আমি আরও লিখিতভাবে আদালতকে জানাব। মিনুর ঘটনার পেছনে একটি চক্র কাজ করছে সেটি তদন্তে বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশনা দাবি করেন এই আইনজীবী। আদালত বলেন, আমরা মনে করি এভাবে যদি রিয়েল (আসল) কালপ্রিট (দোষী) অর্থের বিনিময়ে হোক, অথবা বিভিন্ন কৌশলের মাধ্যমে নিজেকে বাঁচিয়ে অন্য নিরপরাধ লোককে জেলের মধ্যে আটক রাখে সেটা দুর্ভাগ্যজনক। এদিকে শুনানির সময় আইনজীবী শিশির মনিরের সঙ্গে একমত পোষণ করেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ড. বশির উল্লাহ।

তিনি বলেন, আমরাও চাই দোষীদের শাস্তি হোক, নিরপরাধ কেউ যাতে জেলে না থাকে। হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন দণ্ড পাওয়া আসামির বদলে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে দুই বছর ৯ মাস ধরে জেল খাটছেন মিনু। এ ঘটনা জানাজানি হলে মামলার নথি হাইকোর্টে পাঠানোর নির্দেশ দেন চট্টগ্রাম অতিরিক্ত চতুর্থ মহানগর দায়রা জজ। চট্টগ্রামে হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত কুলসুমের পরিবর্তে মিনুর সাজা খাটার ঘটনায় মামলার নথি হাইকোর্টে আসে ২৪ মার্চ। কারা কর্তৃপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মিনুকে আদালতে হাজির করা হলে নতুন করে তার জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়।

সেই সঙ্গে মামলার নথি হাইকোর্টে পাঠানোর নির্দেশ দেন বিচারক শরীফুল আলম ভূঁঞা। পরে নথি একদিনের মধ্যেই হাইকোর্টে আসে। কারাগারে বালাম বই খুঁজতে গিয়ে বিষয়টি উঠে আসে। এরপর বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। পরে বিষয়টি আদালতের নজরে আনেন চট্টগ্রামের আইনজীবী গোলাম মাওলা মুরাদ। প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, আদালতে হাজির হয়ে তিন সন্তানের জননী মিনু তার জবানবন্দিতে জানান, সময়টি ছিল ২০১৮ সালের রমজান মাস। ইফতারি দেয়ার কথা বলে কুলসুম ও মর্জিনা নামের দুজন আদালতে মিনুকে নিয়ে যান।

মিনুকে বলা হয়েছিল ‘কুলসুম’ নাম ডাকা হলে তিনি (মিনু) যেন হাত তোলেন। সে অনুযায়ী হাত তোলার পর কর্তৃপক্ষ তাকে ‘কুলসুম’ হিসেবে চিহ্নিত করে কারাগারে পাঠায়। মিনুকে এভাবে কৌশলে অপরাধী সাজানো কুলসুম একটি হত্যা মামলার আসামি। ২০০৬ সালের জুলাইয়ে চট্টগ্রাম নগরীর কোতোয়ালি থানার রহমতগঞ্জ এলাকায় একটি আমগাছে ঝুলন্ত অবস্থায় পারভীন নামের এক নারীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তদন্তে বেরিয়ে আসে, পারভীনকে শ্বাসরোধে হত্যা করে আত্মহত্যা হিসেবে প্রচারের জন্য গাছে ঝুলিয়ে রাখেন কুলসুম। ২০০৭ সালের ২৬ অক্টোবর কুলসুমকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। এক বছর তিন মাস পর তিনি জামিনে মুক্তি পান।

২০১৭ সালে মামলার রায় ঘোষণা করেন তখনকার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক নুরুল ইসলাম। তাতে কুলসুমকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। সে সময় কুলসুম পলাতক ছিলেন। পরে আইনজীবী নাছির উদ্দীনের মাধ্যমে ২০১৮ সালের জুনে কুলসুম আত্মসমর্পণ করতে চান। আত্মসমর্পণের দিনই মিনুকে কুলসুম হিসেবে সাজিয়ে আদালতে হাজির করা হয়। তখন থেকেই কারাগারে মিনু।


আরোও অন্যান্য খবর
Paris