বৃহস্পতিবার

১৮ই এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

করোনার ক্ষতি দ্রুত কাটিয়ে উঠার প্রক্রিয়া অর্থনীতিতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে

Paris
Update : শুক্রবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২১

এফএনএস : করোনা ভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলায় দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৮টি প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় নামমাত্র সুদে বরাদ্দকৃত অর্ধেক টাকাও ব্যবহার করতে পারেনি। ফলে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন। তাছাড়া বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যেমন কম খরচে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তহবিল ব্যবহার করতে পারছে না, তেমনি করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকরাও কম সুদে ঋণ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

ফলে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে অর্থনীতিতে করোনার ক্ষতি দ্রুত কাটিয়ে উঠার প্রক্রিয়া। এমন পরিস্থিতিতে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে আরো সক্রিয় হওয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের সময়সীমা আরো ৩ মাস বাড়িয়ে ৩০ জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, করোনার নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলায় কম সুদের ঋুনির্ভর ১১টি প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। তার মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অর্থায়নে রয়েছে ৮৮ হাজার কোটি টাকার ৮টি প্যাকেজ। তাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজস্ব উৎস থেকে প্রায় ৬৩ হাজার কোটি টাকা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৬৩ হাজার কোটি টাকার মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো মাত্র ২৯ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা ব্যবহার করতে পেরেছে।

বাকি ৩৩ হাজার ১৫০ কোটি টাকাই ব্যবহার করতে সক্ষম হয়নি। অর্থাৎ ব্যাংকগুলো মাত্র ৪৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ অর্থ ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছে। বাকি ৫২ দশমিক ৫২ শতাংশই ব্যবহার করতে পারেনি। অথচ কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ওসব অর্থ মাত্র এক থেকে তিন শতাংশ সুদে দিচ্ছে। যেখানে ব্যাংকগুলোর আমানত সংগ্রহের গড় খরচ ৫ থেকে ৬ শতাংশ। সেখানে অর্ধেক খরচেরও কমে তহবিল পেয়েও ব্যাংকগুলো তা ব্যবহার করতে পারছে না। আর ওসব ঋণ গ্রাহক পর্যায়ে ৪ থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ সুদে বিতরণ করার কথা। যেখানে ব্যাংকগুলোর ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশ। অর্থাৎ গ্রাহকরাও অর্ধেক কম সুদে ঋণ পেতো। সুদের বাকি সাড়ে ৪ থেকে ৫ শতাংশ সরকার থেকে ভর্তুকি হিসাবে ব্যাংকগুলোকে দেয়া হতো।

সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তহবিলের ব্যবহার বাড়াতে ব্যাংকগুলোকে ব্যাপক ছাড় দেয়া হয়েছে। প্যাকেজ ঘোষণার প্রথমে নিয়ম ছিল বাণিজ্যিক ব্যাংক ঋণ বিতরণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে চাইলে টাকা দেয়া হবে। কিন্তু পরে তা শিথিল করে বলা হয়, ঋণ অনুমোদনের পর বিতরণের আগে চাইলেও টাকা ছাড় করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বড় শিল্প ও সেবা খাতে চলতি মূলধন ঋণ জোগানের জন্য প্রথমে ৩০ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হয়।

তারপর তার পরিমাণ আরো তিন হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে ৩৩ হাজার কোটি টাকা করা হয়। তারপর আরো এক দফায় বিদেশি কোম্পানিগুলোর জন্য ৭ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে ৪০ হাজার কোটি টাকা করা হয়। তার মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক দিচ্ছে ২৫ হাজার কোটি টাকা। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো দেবে ১৫ হাজার কোটি টাকা। ওই ঋণের মধ্যে বড় শিল্প ও সেবা খাতে চলতি মূলধন হিসাবে দেয়া হয়েছে ২৯ হাজার কোটি টাকা।

সূত্র আরো জানায়, দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলে অবস্থিত বিদেশি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের জন্য গঠিত ৭ হাজার কোটি টাকার তহবিলের মধ্যে ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে বিতরণ করা হয়েছে মাত্র ১১০ কোটি টাকা। আর রপ্তানিমুখী শিল্পের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা এ তহবিল থেকে দেয়া হয়েছে ৩ হাজার কোটি টাকা। মোট ৩২ হাজার ১১০ কোটি টাকা দেয়া হয়েছে। তার মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে দেয়া হয় ১৭ হাজার ৭১০ কোটি টাকা। কুটির, অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের (সিএমএসএমই) চলতি মূলধন ঋণ জোগানোর জন্য গঠিত ২০ হাজার কোটি টাকার তহবিলের মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ১০ হাজার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেবে ১০ হাজার কোটি টাকা।

কিন্তু মোট বিতরণ হয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা। তার মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দিয়েছে ৬ হাজার কোটি টাকা। তাছাড়া রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) আকার ৩৫০ কোটি ডলার থেকে ১৫০ কোটি ডলার বা ১২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা বাড়িয়ে ৫০০ কোটি ডলার বা ৪২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা করা হয়। আর তার পুরোটাই দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর সুদের হার পৌনে ২ শতাংশ। তার মধ্যে বিতরণ হয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা। রপ্তানি শিল্পের পণ্য প্রাক-জাহাজীকরণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব অর্থে ৫ হাজার কোটি টাকার একটি পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করা হয়। ওই তহবিল থেকে ঋণ বিতরণের শর্ত দুই দফায় শিথিল করা হয়েছে। তারপরও ঋণ বিতরণ বাড়ছে না।

ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ওই তহবিল থেকে বিতরণ হয়েছে ১৪৫ কোটি টাকা। কৃষিভিত্তিক শিল্পে ঋণ দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব অর্থায়নে ৫ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিলের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা। বাকি দেড় হাজার কোটি টাকা বিতরণ করা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব অর্থে করোনার ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণের জন্য ৩ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হয়। তার মধ্যে ২ হাজার কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। আর কুটির, অতি ক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র শিল্পে ঋণের গ্যারান্টি দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজস্ব অর্থে ২ হাজার কোটি টাকার একটি ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম চালু করা হয়েছে। কিন্তু এখনো তার ব্যবহার হয়নি।

এদিকে এ প্রসঙ্গে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক সংশ্লিষ্টদের মতে, ঋণ দেয়ার আগে শতবার চিন্তা করতে হয় তা ফেরত আসবে কিনা। যদি দেখা যায় ঝুঁকি আছে, তখন কেউ ঋণ দিতে চায় না। আর ব্যাংক মানতে চাইলেও গ্রাহকরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শর্ত মানতে পারছে না। যে কারণে কম সুদের হলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তহবিল ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া ব্যাংক আমানতকারীদের কাছ থেকে আমানত নিয়ে বসে আছে। তার বিপরীতে সুদ দিতে হচ্ছে। কিন্তু বিনিয়োগ করা সম্ভব হচ্ছে না। যে কারণে ব্যাংক নিজেদের তহবিলই বিনিয়োগ করতে চাচ্ছে।

অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক সাবেক গভর্নর জানান, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সক্ষমতার অভাব রয়েছে। তারা নতুন গ্রাহকদের ঋণ দিয়ে ঝুঁকি নিতে চায় না। ফলে নতুন গ্রাহক ঋণ পাচ্ছে না। ব্যাংকগুলো পুরনো গ্রাহকদের ঋণ দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছে। অথচ করোনার প্রভাব মোকাবেলায় নতুন গ্রাহকদের ঋণ দেয়াটা জরুরি। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাকা পেতে নানা শর্ত পালন করতে হয়। সেগুলো ব্যাংকের ক্ষেত্রে যেমন আছে, তেমনি গ্রাহকদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কিন্তু তাতে অনেকেই স্বচ্ছতা আনতে চায় না। যা একটি বড় দুর্বলতা।


আরোও অন্যান্য খবর
Paris