শনিবার

২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বরেন্দ্র অঞ্চলে বিএমডিএ’র হাজার হাজার গভীর নলকূপ অকার্যকর

Paris
Update : বুধবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২১

এফএনএস : বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) বিপুলসংখ্যক গভীর নলকূপই অকার্যকর হয়ে পড়েছে। বর্তমানে বরেন্দ্র অঞ্চলের ১ হাজার ৩৫৮টি পুরনো গভীর নলকূপ সংস্কার দরকার। বিশেষ করে পুনঃখনন, পাম্প হাউজ নির্মাণ ও বিদ্যুৎ লাইনের পুনঃসংযোগ প্রয়োজন। তাছাড়া ২ হাজার ৩০৯টি পুরনো ও ব্যবহার অযোগ্য পাম্প হাউজ পুননির্মাণ, ২ হাজার ৯৮৭টি পুরনো পাম্প হাউজ মেরামত, ২০০টি অটোমেটিক গ্রাউন্ড ওয়াটার ডাটা লগার স্থাপন ও ৩০০টি বিদ্যুৎ লাইন মেরামত ইত্যাদি কার্যক্রমের প্রস্তাব করা হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন বিএমডিএর ওসব তথ্য যাচাই-বাছাই করে প্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণের বিষয়ে সুপারিশ করবে বলে বিএমডিএ সংশ্লিষ্টরা আশাবাদী। বিএমডিএ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) কৃষকদের জমিতে পানি দেয়ার সুবিধার্থে ও ভূগর্ভস্থ-ভূউপরিস্থ পানি সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের জন্য বরেন্দ্র অঞ্চলে বছরব্যাপী সেচ কার্যক্রম পরিচালনা করে। আর ওই কার্যক্রম পরিচালনার জন্য রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে বিএমডিএর নিয়ন্ত্রণাধীন ১৫ হাজার ৫১৭টি গভীর নলকূপ রয়েছে। সাধারণত ২০ থেকে ২৫ বছর ওসব নলকূপের জীবনকাল ধরা হয়। তবে বিএমডিএর ওসব নলকূপের একটি বড় অংশের বয়সই ২৫ থেকে ৪০ বছর পেরিয়ে গেছে। ফলে সংস্কার ছাড়া ওসব নলকূপের প্রায় ৪৩ শতাংশেরই কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

মূলত দীর্ঘ সময় ধরে বিপুল পরিমাণ জমির সেচকাজের জন্য একটি করে নলকূপই কাজ করে গেছে। কিন্তু যথাসময়ে বা যথানিয়মে সেগুলোর সংস্কার হয়নি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই নানা ত্রুটি দেখা দিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই গভীর নলকূপগুলোর ঘরের ছাদ ও বিম ভেঙে পড়ছে। ত্রুটি নিয়েই অপারেটররা ঢিলেঢালাভাবে সেচ কাজ পরিচালনা করছে। ত্রুটির কারণে সেচযন্ত্রগুলোর পানি উত্তোলনের গতি কমে গেছে। যেহেতু সেচযন্ত্র ব্যবহারের জন্য কৃষকদের অর্থ দিতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে উত্তোলনের গতি কমায় কৃষকদের প্রয়োজনীয় পানির জন্য বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে। আবার সেচযন্ত্র নষ্ট হয়ে গেলে তা মেরামতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। তখনো কৃষকরা বিপাকে পড়ে।

সূত্র জানায়, দেশে আবাদি জমি বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৯৬১-৬২ অর্থবছরে সেচযন্ত্রের ব্যবহার শুরু হয়। ওই বছর ১ হাজার ৫৫৫টি শক্তিচালিত পাম্প দিয়ে ওই সেচ কার্যক্রম চালু করা হয়। আর ১৯৬৭-৬৮ সালে বিএডিসি গভীর নলকূপ স্থাপন করে সেচকাজে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার শুরু করে। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে স্থাপন শুরু হয় অগভীর নলকূপ স্থাপন। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলার অধিকাংশ এলাকা এবং নাটোরসহ বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া ও পাবনা জেলার কিয়দংশ এলাকাজুড়ে বরেন্দ্র অঞ্চল অবস্থিত। দেশের অন্যান্য স্থানের তুলনায় ওই অঞ্চলের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন।

মাটির গঠন ও ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের কারণে ওসব অঞ্চলে প্রচলিত গভীর নলকূপ দিয়ে সেচকাজ সম্ভব ছিল না। ১৯৮৫ সালে ওই অঞ্চলের জন্য বিএডিসির প্রকৌশলীরা এক ধরনের গভীর নলকূপ উদ্ভাবন করে, যার মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করে সেচকাজে লাগানো যায়। বরেন্দ্র এলাকার সার্বিক উন্নয়নের জন্য রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলার ১৫টি উপজেলাকে সম্পৃক্ত করে বিএডিসির অধীনে বরেন্দ্র সমন্বিত এলাকা উন্নয়ন প্রকল্প (বিআইএডিপি) নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ওই প্রকল্পের আওতায় ছিল সেচকাজের জন্য গভীর নলকূপ স্থাপন, সংস্কারের অভাবে পানির ধারণ ক্ষমতা না থাকা পুকুর ও খাল পুনঃখনন, বৃক্ষরোপণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে সড়ক নির্মাণ।

প্রকল্পটির সাফল্যের কারণে সমগ্র বরেন্দ্র এলাকার উন্নয়নের জন্য ১৯৯২ সালে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলার সমগ্র ২৫টি উপজেলাকে অন্তর্ভুক্ত করে বিএডিসির কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) গঠিত হয়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন বিএমডিএ পরিচালিত হয়। বর্তমানে সংস্থাটির অধীন ১৫ হাজার ৫১৭টি গভীর নলকূপ ও ৫১৯টি এলএলপি পাম্প রয়েছে। সব মিলিয়ে ১৬ হাজারের বেশি সেচযন্ত্রের মাধ্যমে বরেন্দ্র অঞ্চলের সেচ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। সূত্র আরো জানায়, বিএমডিএ নওগাঁ জেলাকে দুটি জোনে ভাগ করে ৪ হাজার ১০৩টি গভীর নলকূপের মাধ্যমে সেচ কার্যক্রম চালায়। তার মধ্যে নওগাঁ সদর উপজেলার তিলকপুর ইউনিয়নের ইকরতারা গ্রামে ২০০৯ সালে ২২০ বিঘা জমির জন্য মাত্র একটি গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়।

একই উপজেলার হাঁসাইগাড়ি ইউনিয়নের চকআব্রুশ গ্রামে ১৯৯৫ সালে ১৭০ বিঘা জমির জন্য একটি গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়। কিন্তু একটি মাত্র নলকূপের ওপরই অনেক কৃষককে নির্ভর করতে হয়। তার ওপর মাঝেমধ্যেই সেটি নষ্ট হয়ে যায়। স্থানীয় কৃষকদের অভিযোগ, ২৫ বছর আগে গভীর নলকূপ স্থাপন করার সময়ই বিএমডিএ পুরনো মোটর দিয়েছিল। ফলে এখন প্রায়ই নষ্ট হয় ওই যন্ত্র আর বিপাকে পড়ে গ্রামের কৃষকরা। বরেন্দ্র অঞ্চলের বেশির ভাগ এলাকার কৃষকদের এমন অভিযোগ।

এদিকে পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সেচ অনুবিভাগ ইতিমধ্যে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির মিটিং (পিইসি) করেছে। সেখানে প্রাথমিকভাবে ৩৩০ কোটি ২৯ লাখ টাকা ব্যয় নির্ধারণ করে প্রাথমিক প্রকল্প নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বলা হয়, বিভিন্ন ধরনের ৬ হাজার ৬৫৪টি সেচ অবকাঠামো সংস্কারের মাধ্যমে ৪০ হাজার ৭৪০ হেক্টর জমিতে সেচ কার্যক্রম অব্যাহত রেখে অতিরিক্ত প্রায় ৩ লাখ ৪৬ হাজার টন ফসল উৎপাদন করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। তাছাড়া পিইসি সভায় বেশকিছু বিষয়ে ব্যাখ্যাও চাওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বেশকিছু সুপারিশও করা হয়েছে। সেগুলো বাস্তবায়ন সাপেক্ষে দেশের উত্তরাঞ্চলের কৃষির জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য সুপারিশ করা হবে।

অন্যদিকে বরেন্দ্র অঞ্চলের বিপুলসংখ্যক গভীর নলকূপ অকার্যকর হয়ে পড়া প্রসঙ্গে বিএমডিএর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. শামসুল হুদা জানান, গভীর নলকূপগুলোর জীবনকাল অতিক্রম করায় নলকূপের হাইজিং পাইপ, স্ট্রেইনার, রিডিউসার ইত্যাদি নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে পানির সঙ্গে বালি ও পাথর নির্গত হচ্ছে। নলকূপের পাম্প হাউজগুলো দীর্ঘদিন মেরামত ও সংস্কার না করার কারণে ঘরের দেয়াল, ছাদ ও বিম ভেঙে পড়ছে।

তাছাড়া পাম্প ও ট্রান্সফরমার অনেক পুরনো হয়ে যাওয়ায় ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ফলে সেচ কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে। তবে সরকার বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। কৃষিকে শক্তিশালী করতে বা ফসলের উৎপাদন বাড়াতে যন্ত্রগুলোর সংস্কার প্রয়োজন। ওই লক্ষ্যে সম্ভাব্যতা যাচাই করে দ্রুত প্রকল্প নিতে পরিকল্পনা কমিশনের কাছে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। আশা করা যায়, খুব দ্রুতই ওসব সংস্কার ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ কেনার জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা পাওয়া যাবে।


আরোও অন্যান্য খবর
Paris