চারঘাট প্রতিনিধি : রাজশাহী জেলা থেকে ২৭ কিলোমিটার দক্ষিণে পদ্মা-বড়াল বিধৌত চারঘাট উপজেলা। এ উপজেলার থানাপাড়া গ্রামে ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল মঙ্গলবার বেলা ১২টায় ঘটেছিল এক হৃদয়বিদারক ঘটনা। যা মনে পড়লে আজও বুক কেঁপে ওঠে। আজ সেই ১৩ এপ্রিল। বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাসে এক বেদনাবিধুর দিন আজ। যা চারঘাট গণহত্যা দিবস হিসাবে পরিচিতি পায়। আজ থেকে ৫০ বছর আগে, একাত্তরের এই দিনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের সেই অগ্নিঝরা ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে চারঘাটের একদল যুবক মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশকে স্বাধীনতা এনে দেওয়ার শপথ নেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন, থানাপাড়া গ্রামের শহীদ শিবলী, আকরাম আলী, মোকাররম হোসেন হেজু, মোজাফফর হোসেন বাদল, নুরুল হক, হুমায়ুন কবীর, তবিবার রহমান, চারঘাটের শ্রী গোপাল কুমার শীল, দেলশাদ চৌধুরী ও নজের আলী।
সেদিন সকালে অস্ত্রে সজ্জিত বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অতর্কিত হামলা চালিয়ে চারঘাট উপজেলার থানাপাড়া গ্রামসহ কুঠিপাড়া, গৌরশহরপুর, বাবুপাড়ার প্রায় ২০০ নিরস্ত্র বেসামরিক লোককে গুলি করে হত্যা করে। সেদিন আরও প্রায় ২শ’ মানুষ আহত হন। সেদিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বর্তমান কাউন্সিলর আজমল হোসেন মতি ও থানাপাড়া সোয়ালোজের পরিচালক রায়হান আলী জানান, চারঘাট পাইলট উচ্চবিদ্যালয় ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের মূল ক্যাম্প। বেলা ১০টার পর খবর এলো, নাটোর থেকে রাজশাহীর দিকে আসছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দল। তবে তখনো জানা যায়নি, তারা পুলিশ একাডেমি সারদাতে আসছে। দুদিন আগে সারদা পুলিশ একাডেমির যত অস্ত্র ছিল সবগুলো ক্যাপ্টেন রশিদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সায়রন বাঁজিয়ে সারদায় অবস্থিত তৎকালীন পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার থেকে লুট করা অস্ত্র উদ্ধার করতে আসে। সারদা আসতে গিয়ে পাকিস্তানি হানাদাররা মোক্তারপুর ট্রাফিক মোড় ও সারদা বাজারে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে বাধাপ্রাপ্ত হলে আধাঘণ্টা গুলিবিনিময় হয়। শহীদ হন ইউসুফ ও দিদারসহ বেশ কয়েকজন। পাকিস্তানি হানাদাররা পুলিশ একাডেমির ভেতরে গিয়ে পদ্মা নদীর চরে ভীতসন্ত্রস্ত্র নিরস্ত্র কয়েক হাজার নারী-পুরুষ ও শিশু দেখতে পায়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পদ্মার চারপাশে তাদের ঘেরাও করে। পুরুষদের অপেক্ষা করতে বলে, নারী ও শিশুদের বাড়ি ফিরে যেতে নির্দেশ দেন। তারপর শুরু হয় ব্রাশফায়ার, সারি সারি মৃতদেহ, আকাশে উঠছে ধোঁয়ার কুন্ডলী।
শুধু গুলি করেই ক্ষান্ত হননি হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী, মৃত্যু নিশ্চিত করতে পেট্রল ঢেলে শিবলী নামে এক তরুণ যোদ্ধার লাশ আগুন জ্বালিয়ে লাশ পুড়িয়ে ফেলার চেষ্টা করে। আরও জানান, বীর মুক্তিযোদ্ধা খুরশীদ আলম শিবলী ছিলেন ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র। তিনি উপজেলার থানাপাড়ার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। যাকে পাকিস্তানি বাহিনী ধরে নিয়ে গিয়ে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলার জন্য বেয়নেট চার্জ করে। শত নির্যাতন সত্ত্বেও পাকিস্তানি হায়েনারা শিবলীর মুখ থেকে ‘জয় বাংলা’ ছাড়া কোনো শব্দ বের করতে পারেনি। পরে শিবলীকে নির্মমভাবে হত্যা করে। শিবলী যেন জীবন্ত কিংবদন্তি। তার নির্মম ও রোমহর্ষক হত্যাকান্ডের কথা শুনতে ও সমবেদনা জানাতে বিভিন্ন এলাকা থেকে নানা শ্রেণির মানুষ থানাপাড়ায় তার বাড়িতে ভিড় জমায়। ১৩ এপ্রিল প্রতিবছর থানাপাড়াবাসীকে স্মরণ করিয়ে দেয় ‘৭১ সালের ভয়াবহ দিনগুলোর কথা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, চারঘাট-বাঘা আসনের সাংসদ ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের চেষ্টায় ২০১১ সালে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের উদ্যোগে চারঘাট পল্লী বিদ্যুৎ মোড়ে নির্মিত হয়েছে ১৭৪ জন শহীদের নাম সংবলিত স্মৃতিস্তম্ভ। সৌরবাতিসহ বিশেষ আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে সেখানে। স্মৃতিস্তম্ভ দেখভাল করার জন্য একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকও রাখা হয়েছে।
চারঘাট উপজেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মিজানুর রহমান আলমান বলেন, থানাপাড়াসংলগ্ন বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির নিচে পদ্মাতীরবর্তী জায়গায় গণহত্যা ঘটলেও নির্মিত হয়নি বধ্যভূমি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে বধ্যভূমি নির্মাণের দাবি জানান তিনি। এ ব্যাপারে চারঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দা সামিরা বলেন, ১৭৪ জন শহীদের নামসংবলিত স্মৃতিস্তম্ভটির সম্মান বজায় রাখতে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। করোনার কারনে এ দিবস উপলক্ষে উপজেলা প্রশাসনের কোনো কর্মসূচী নেই। তবে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গুলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে ‘চারঘাট গণহত্যা দিবস’ পালন করতে পারবে।