এফএনএস : দেশের সিগারেটে অব্যাহতভাবে রাজস্ব ফাঁকি চলছেই। মূলত জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নির্ধারিত ট্যাক্স স্ট্যাম্প ও ব্যান্ডরোল নকল এবং পুনরায় ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতি বছর দেড় থেকে দুই হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকির ঘটনা ঘটছে। দেশের আনাচে-কানাচে গড়ে ওঠা ছোট ও মাঝারিমানের বিভিন্ন কোম্পানি দীর্ঘদিন ধরে এমন অপতৎপরতায় লিপ্ত। পরিস্থিতি সামাল দিতে অভিযান চালিয়ে পণ্য জব্দ, জরিমানা, এমনকি কারখানা সিলগালা করেও রাজস্ব ফাঁকি ঠেকানো যাচ্ছে না। ফলে একদিকে সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে। অন্যদিকে কম দামে নিম্নমানের সিগারেট বাজারজাত হওয়ায় ধূমপান কমিয়ে আনার লক্ষ্য অর্জন হচ্ছে না। এনবিআর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, অবৈধ ব্যান্ডরোল ব্যবহার বন্ধে সরকারের নানামুখী উদ্যোগ থাকলেও টেকসই কোনো সমাধান আসছে না। কর কর্মকর্তারা এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দেশের বিভিন্ন জায়গায় রাজস্ব ফাঁকি দেয়া সিগারেটের কারখানায় অভিযান চালালেও অপরাধ বন্ধ হচ্ছে না। অভিযানের পরে কারখানাগুলো কিছুদিন বন্ধ থেকে আবারো চালু হয়। রাজস্ব ফাঁকি দেয়া সিগারেট কোম্পানিগুলোর উৎপাদন কার্যক্রম একটু ভিন্ন। বিভিন্ন গোপন স্থানে অন্য পণ্যের কারখানায় তারা সিগারেট উৎপাদন করে।
এমনকি রাজস্ব কর্মকর্তা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে গভীর রাতে উৎপাদন পরিচালনা করা হয়। তবে বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪-এর ধারা ২৫ (ক) অনুযায়ী সিগারেট স্ট্যাম্প/ব্যান্ডরোল জালিয়াতি করা মুদ্রা নকল করার সমতুল্য একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ওই অপরাধের শাস্তি সর্বনিম্ন ১৪ বছর থেকে সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ড। আইনে কঠোর শাস্তির বিধান থাকলেও অপরাধীরা তার তোয়াক্কা করছে না। রাজস্ব ফাঁকি দেয়া রোধে সরকারের পদক্ষেপ থাকলেও কার্যকরভাবে ওই অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। জাল ও পুনর্ব্যবহৃত ট্যাক্স স্ট্যাম্প ও ব্যান্ডরোলের মাধ্যমে বছরে আনুমানিক দেড় থেকে দুই হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হচ্ছে।
সূত্র জানায়, বেশ কয়েকটি কোম্পানি চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার বাজারে অবৈধ ট্যাক্স স্ট্যাম্প ও ব্যান্ডরোল ব্যবহার করে সিগারেট বাজারজাত করছে। ফলে ওসব এলাকার বাজারে ১০ শলাকার সিগারেটের প্যাকেট ২০ থেকে ২৫ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। অথচ চলতি অর্থবছরের (২০২০-২১) বাজেটে এনবিআর ১০ শলাকার প্যাকেটের সর্বনিম্ন দাম ৩৯ টাকা নির্ধারণ করেছে। যথাযথ রাজস্ব পরিশোধ করলে তার চেয়ে কম দামে সিগারেট বিক্রির সুযোগ নেই।
যেসব কোম্পানি সরকারকে রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে তারাই ২০ থেকে ২৫ টাকায় সিগারেট বাজারজাত করতে পারছে। ফলে সরকার ওই খাত থেকে আশানুরূপ রাজস্ব আহরণ করতে পারছে না। বিশ্বে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যেখানে সরকার বাজেটের মাধ্যমে সিগারেটের কর নির্ধারণের পাশাপাশি খুচরা মূল্যও নির্ধারণ করে থাকে। প্রতি বছরই সিগারেটের কর বাড়ানো হয়। তার উদ্দেশ্য বেশি রাজস্ব আয় এবং জনস্বার্থ সুরক্ষার্থে ধূমপায়ীর সংখ্যা কমানো। কিন্তু নকল বা পুনর্ব্যবহৃত ট্যাক্স স্ট্যাম্প ও ব্যান্ডরোলের সিগারেটের কারণে ওই উদ্দেশ্য পূরণ হচ্ছে না।
সূত্র আরো জানায়, সিগারেটে একই ব্যান্ডরোল বারবার ব্যবহারের ঘটনা শুল্ক গোয়েন্দাদের অভিযানেও ধরা পড়ছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ভ্যাট নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর অবৈধ ব্যান্ডরোল ব্যবহারের দায়ে একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলাও করেছে। আইন অনুযায়ী বৈধ ভ্যাট চালান ছাড়া সিগারেট পরিবহন অবৈধ। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে ভ্যাট চালান ছাড়া কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে অন্যান্য পণ্যের আড়ালে সিগারেট পরিবহন হচ্ছে। মূলত অবৈধ ব্যান্ডরোলের সিগারেটই কুরিয়ারে পরিবহন হচ্ছে। ভ্যাট গোয়েন্দারা গত বছরের আগস্টে ঢাকার শান্তিনগরে এসএ পরিবহনের ডিপোতে অভিযান চালিয়ে নকল ট্যাক্স স্ট্যাম্প/ব্যান্ডরোলসহ ১৪ বস্তা সিগারেট আটক করে।
যার মূল্য ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা। ওসব সিগারেটের একটি চালান কুষ্টিয়া থেকে আসে। আরেকটি চালান বগুড়া থেকে আসে। দুটি চালানে ‘সিজার’ ও ‘সেনর গোল্ড’ নামের দুই ব্র্যান্ডের ৩ লাখ ৯০ হাজার শলাকা ছিল। জানা যায়, রাজস্ব ফাঁকি দেয়া উল্লেখযোগ্য সিগারেট ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে রয়েছে গাজীপুরের ভার্গো টোব্যাকোর পার্টনার, কুষ্টিয়ার নাসির টোব্যাকোর টপ টেন, ভৈরবের তারা ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকোর স্মার্ট ব্ল্যাক, হেরিটেজ টোব্যাকোর সিটি গোল্ড, মারবেল ইত্যাদি। পার্টনার ব্র্যান্ডের সিগারেট সিলেট অঞ্চলের বাজারে বেশি পাওয়া যায়। স্মার্ট ব্ল্যাক চট্টগ্রামে, টপ টেন ও নাসির গোল্ড রাজশাহী ও বগুড়া জেলার বাজারে বেশি পাওয়া যায়। সিটি গোল্ড এবং মারবেল সিলেট ও চট্টগ্রাম বাজারে বেশি পাওয়া যায়।
এদিকে সিগারেট খাতে রাজস্ব ফাঁকি দেয়া প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সিগারেট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের মুখপাত্র শেখ শাবাব আহমেদ জানান, নিম্নস্তরের সিগারেটে সরকার ৩৯ টাকা খুচরা মূল্যের ওপর ৭৩ শতাংশ অর্থাৎ ২৮ টাকা ৪৭ পয়সা কর পাচ্ছে। ফলে কর না দিলে ওই ২৮ টাকা ৪৭ পয়সা সংশ্নিষ্ট ব্যবসায়ীর পকেটেই যাচ্ছে। এক শ্রেওণির অসাধু ব্যবসায়ী নকল ও পুনর্ব্যবহৃত ট্যাক্স স্ট্যাম্প ও ব্যান্ডরোল ব্যবহার করে অবৈধভাবে সিগারেট বাজারে ছাড়ছে।
অন্যদিকে একই প্রসঙ্গে ঢাকা পশ্চিমের ভ্যাট কমিশনারেট অফিসের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, সিগারেট নিয়ে দেশে বড় ধরনের জালিয়াত চক্র গড়ে উঠেছে। নকল, চোরাই পথে আমদানি ও একই ট্যাক্স স্ট্যাম্প বারবার ব্যবহার করে বাজারজাত করাসহ বিভিন্ন উপায়ে রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হয়ে থাকে। এক শ্রেণির লোক অনুমোদনহীন কারখানা স্থাপন করে বাজারে প্রচলিত ও বিদেশি সিগারেট হুবহু নকল করে বাজারে ছাড়ছে। এ অনিয়ম বন্ধ করা গেলে রাজস্ব যেমন বাড়বে, তেমনি সরকারের ধূমপান কমানোর লক্ষ্যও সহজে অর্জন হবে।