শুক্রবার

২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

নথি জালিয়াতি করে উচ্চ-নিম্ন আদালত থেকে জামিনে বেরিয়ে যাচ্ছে আসামিরা

Paris
Update : বৃহস্পতিবার, ১ এপ্রিল, ২০২১

এফএনএস : দেশের আদালত চত্বরেও জালিয়াত চক্র বেপরোয়া। অসাধু ওই চক্রের সদস্যরা তথ্য গোপন করে অথবা নথি জালিয়াতি করে উচ্চ ও নিম্ন আদালত থেকে আসামি জামিনে বের করে নিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে জালিয়াতি বন্ধে উচ্চ আদালত থেকে বিভিন্ন সময়ে নির্দেশনা দেয়াসহ একাধিক মামলাও হয়েছে। কিন্তু তারপরও জামিন জালিয়াতি থামছে না। গত কয়েক মাসে হাইকোর্টে অন্তত ৫টি জামিন জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়েছে। জাল নথি সৃজনের পাশাপাশি তথ্য গোপন ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে হত্যা, অস্ত্র, ধর্ষণ ও মাদক মামলাসহ বিভিন্ন গুরুতর মামলায় হাইকোর্ট থেকে জামিন নেয়া হচ্ছে। জামিন নেয়ার ক্ষেত্রে ভুয়া এফআইআর, চার্জশিট, জব্দ তালিকা দাখিল করা হচ্ছে।

অভিযোগের গুরুত্ব কমিয়ে তৈরি করা কাগজপত্র দেখিয়ে আদালতকে বিভ্রান্ত করে আদেশ পক্ষে নেয়া হচ্ছে। মূলত ফৌজদারি বিবিধ শাখায় ওসব ঘটনা বেশি ঘটছে। ওসব জালিয়াতিতে একাধিক চক্র জড়িত। জামিন আদেশের কপি জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ইতঃপূর্বে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন ফৌজদারি মিস শাখার এক কর্মীকে বরখাস্ত করে। সম্প্রতি আবারো বেশ কয়েকটি জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়েছে। আদালত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, হাইকোর্টের নির্দেশে নথি ও জামিন জালিয়াতির ঘটনায় সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন এ পর্যন্ত প্রায় ৬০টির মতো মামলা করেছে। তার মধ্যে ফৌজদারি বিবিধ শাখা থেকে ৩৯টি, রিট শাখা থেকে ৯টি, ফৌজদারি আপিল শাখা থেকে ২টি এবং অন্যান্য শাখা থেকে ১০টি মামলা করা হয়। ওসব মামলা তদন্ত ও বিচারাধীন রয়েছে। তাছাড়া গত বছরের নভেম্বরে প্রতারণার মাধ্যমে হাইকোর্ট থেকে জামিন নেয়ার ঘটনায় সুপ্রিমকোর্টের এক আইনজীবী, গোপালগঞ্জ আদালতের ৪ কর্মকর্তাসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন পৃথক দুটি মামলা করে। শাহবাগ থানায় দুটি মামলা হয়। কিন্তু সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে মামলাগুলো বিচারিক আদালতে ঝুলে রয়েছে। মামলার নিষ্পত্তি হচ্ছে খুবই কম।

সূত্র জানায়, এক আসামি তথ্য গোপন করে জামিন আবেদন করায় ফেঁসে যায়। তথ্য গোপনের বিষয়টি নজরে এলে ওই মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তিনি কোনো আদালতে জামিন আবেদন করতে পারবেন না বলে হাইকোর্ট আদেশ দেন। একই সঙ্গে ওই আদালতে ওই ব্যক্তির আইনজীবী দুই মাস জামিন আবেদন পরিচালনা করতে পারবেন না বলেও সিদ্ধান্ত দেয়া হয়। তাছাড়া বগুড়া সদরের ৩০ জন আসামি হাইকোর্টের দুই বিচারপতির নাম উল্লেখ করে ১৪ ফেব্রুয়ারি জামিন পায়। অথচ সেদিন ওই কোর্ট থেকে এমন কোনো জামিনাদেশই হয়নি। এমনকি সেখানে আইনজীবীদের যে নাম উল্লেখ করা হয়েছে তারও কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি।

ওই মামলায় ভুয়া আগাম জামিননামা তৈরির ঘঁনায় ৩০ জনকে গ্রেফতার করতে হাইকোর্ট ২৪ ফেব্রুয়ারি নির্দেশ দিয়ে ৭ দিনের মধ্যে তাদের গ্রেফতার করতে বগুড়া সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) বলা হয়। তাছাড়া বিষয়টি তদন্ত করতে বগুড়ার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকেও নির্দেশ দেয়া হয়। ১৬ মার্চ নির্ধারিত দিনে প্রতিবেদন না আসায় আদালত উষ্মা প্রকাশ করেন। তাছাড়া মাদক মামলার আসামি সফিউল্লাহ খান ২০১৯ সালের ৬ নভেম্বর হাইকোর্ট থেকে জামিন পায়। জামিননামা আদেশ নিম্ন আদালতে (গোপালগঞ্জ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত) পাঠানো হয়। তারপর আসামি শফিউল্লাহ খানের জামিননামা দাখিল করলে তা গ্রহণ করা হয়।

কিন্তু ওই সময় আদালতের দৃষ্টিতে আসে যে, আসামির দখল থেকে ২২০০ পিস ইয়াবা উদ্ধারের অভিযোগ থাকলেও হাইকোর্টের আদেশে ২২ পিস ইয়াবা উদ্ধারের কথা রয়েছে। তারপর গোপালগঞ্জ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত বিষয়টি হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে অবহিত করেন। রেজিস্ট্রার জেনারেল বিষয়টি সংশ্লিষ্ট জামিন দেয়া বিচারপতিদের অবহিত করেন। পরে আদালত জাল-জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করার জন্য নির্দেশ দেন। একইভাবে মাদক মামলায় মিথ্যা তথ্য দিয়ে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানি উপজেলার দুই আসামি ৬ জানুয়ারি হাইকোর্ট থেকে জামিন নেয়।

কিন্তু ৪ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের নজরে আসে যে, মিথ্যা তথ্য দিয়ে তারা জামিন নিয়েছে। তদন্ত করে এর সত্যতা পাওয়া গেলে হাইকোর্ট জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলার নির্দেশ দেন। তাছাড়া ২০১৪ সালে কাতারে ৪ জন মিলে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে এক বাংলাদেশি ঠিকাদারকে হত্যা করে। হত্যাকারীরা পরদিন দেশে ফিরে স্বজনদের কাছে খুনের কথা স্বীকার করে এবং নিহত ব্যক্তির বৃদ্ধ বাবাকে হত্যার হুমকি দেয়। ওই ঘটনায় মামলা হরলে দুজন গ্রেফতার হয়। ইতোমধ্যে হত্যা মামলায় কাতারে ওই ৪ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। কিন্তু সম্প্রতি হাইকোর্ট থেকে তথ্য গোপন করে জামিন নিয়ে কারাগার থেকে এক আসামি বেরিয়ে গেছে।

বিষয়টি নজরে এলে ওই ব্যক্তির জামিন বাতিল করে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন আদালত।
এদিকে আদালত থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে জামিনে আসামি বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনায় আদালতের সিনিয়র আইনজীবীরা উদ্বিগ্ন। তাদের মতে, উচ্চ আদালতে একের পর এক জামিন জালিয়াতির খবর শোনা যাচ্ছে। বিশেষ করে মাদক ও অস্ত্র মামলার ক্ষেত্রে ওসব জালিয়াতি হয়। অথচ জামিন জালিয়াতির ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ না হলে পরে আর নেয়া হয় না।

এভাবেই অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে হাইকোর্ট বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, জামিন জালিয়াতি রোধে আদালতের পক্ষ থেকে তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা হচ্ছে। অভিযোগ পেলেই তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। জামিন জালিয়াতির ঘটনায় সুপ্রিমকোর্টের পক্ষ থেকে যেসব মামলা হয়েছে সেগুলোর তদন্ত চলছে। জালিয়াতিতে কারা জড়িত তা পুলিশের তদন্তেই বেরিয়ে আসবে।


আরোও অন্যান্য খবর
Paris