শুক্রবার

১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সর্বশেষ সংবাদ
বাগমারায় এক স্কুলের সভাপতি ও সহকারী প্রধান শিক্ষক এলাকাছাড়া! বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অবিচল জাতীয় চার নেতা কখনো মৃত্যু ভয় করেননি : লিটন প্রেমিককে কুপিয়ে জখম করল প্রেমিকা! গোদাগাড়ীতে দু’পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনায় আরো ২ আসামি গ্রেপ্তার এমপি-মন্ত্রীর স্বজনদের সরে দাঁড়াতে নির্দেশ সেনাবাহিনীতে ভুয়া নিয়োগ দিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়া তিন প্রতারক রাজশাহীতে গ্রেফতার পুঠিয়ায় শাশুড়িকে হত্যা করে লাশ গুম করেছিলেন পুত্রবধূ! রাজশাহীর ঢাকা বাসস্ট্যান্ডে আরডিএ’র জায়গা দখল করে স্থাপনা নির্মাণ! সারাদেশে উপজেলা নির্বাচনে ‘হস্তক্ষেপ’ নিয়ে চিন্তিত প্রার্থীরা মুজিবনগর সরকার আমাদের প্রেরণা : আসাদ

অবৈধ ইটভাটা গিলে খাচ্ছে রাজশাহী অঞ্চলের উর্বর ফসলি জমি

Paris
Update : রবিবার, ২১ মার্চ, ২০২১

ইউসুফ আলী চৌধূরী, পবা : বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলে অবৈধ ইটভাটার ছড়াছড়ি। পরিবেশ অধিদপ্তরের তরফ থেকে হাতেগোনা কিছু ইটভাটার ছাড়পত্র রয়েছে। লাইসেন্স রয়েছে অন্তত অর্ধশত ইটভাটার। আর বাকি সব ইটভাটাই অবৈধ। পরিবেশ অধিদপ্তরের দেয়া তথ্যানুযায়ী, রাজশাহী অঞ্চলের চারটি জেলায় (রাজশাহী, চাঁপইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও নাটোর) অবৈধ ইটভাটার সংখ্যা অন্তত সাড়ে ৪০০টি। তবে বেসরকারি হিসেবে এ সংখ্যা আরো অনেক বেশি হবে বলে সূত্র জানিয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট প্রশাসন এ ব্যাপারে নির্বিকার। জনবল কম থাকার অজুহাত দেখিয়ে রাজশাহী পরিবেশ অধিদপ্তর অনেকটা চুপ। সরকারি এই দপ্তরটি কিছু রুটিন ওয়ার্ক করলেও বাস্তবে মাঠ পর্যায়ে অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে কার্যকর ও আইনানুগ ব্যবস্থাগ্রহণে সন্তোষজনক তৎপরতা নেই বলে অভিযোগ রয়েছে।

বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অবৈধ ইটভাটা রাজশাহী অঞ্চলের উর্বর ফসলি জমি খেয়ে ফেলছে। এতে কমছে জমির উর্বরা শক্তি। এসব ইটভাটায় নিম্নমানের কয়লা পোড়ানোয় বাড়ছে দূষণ। নষ্ট হচ্ছে ফসলের ক্ষেত, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন শতশত কৃষক। এছাড়া স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে মানুষ।
রাজশাহী আঞ্চলিক কৃষি দপ্তরের একটি সূত্র জানায়, দুই বছর আগের তথ্যানুযায়ী অবৈধ ইটভাটায় চলে গেছে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও নাটোরের অন্তত এক হাজার ৬১৬ হেক্টর উর্বর কৃষিজমি। এরমধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জে সবচেয়ে বেশি ইটভাটা গড়ে উঠেছে। ইটভাটায় চলে যাওয়া সেখানকার ৫৩০ দশমিক ২৬ হেক্টর জমির সম্পূর্ণটাই উর্বর ফসলি ক্ষেত।

এছাড়া রাজশাহীতে ৩২৫ হেক্টর, নওগাঁয় ৪৭০ হেক্টর এবং নাটোরে ২৯১ হেক্টর জমিতে গড়ে উঠেছে ইটভাটা। বর্তমানে এ সংখ্যা আরো বেশি হবে বলে সংশ্লিষ্ট অপর একটি সূত্র জানিয়েছে। তবে এ অঞ্চলে ইটভাটার সংখ্যা কত তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য কৃষি দপ্তরে নেই। সূত্র বলছে, শুকনা মৌসুমে যেসব বিলে পানি থাকে না, সেসব বিলের ফসলি জমিতে ইটভাটা গড়ে উঠেছে বা উঠছে। এতে ফসলি জমি কমছে, চাপ পড়ছে কৃষির ওপর। গত ছয় বছরে অন্তত দেড় শতাধিক ইটভাটা গড়ে উঠেছে রাজশাহী জেলায়। এখন এ জেলায় ইটভাটার সংখ্যা অন্তত দেড় শতাধিক। এর মাত্র ১৩টির নিবন্ধন দিয়েছে জেলা প্রশাসকের দপ্তর।

বৈধ ও অবৈধ ইটভাটার সংখ্যা কত তা নিয়ে রাজশাহী পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যেও রয়েছে গড়মিল। তাদের তথ্যানুযায়ী, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও নাটোর জেলায় আনুমানিক সাড়ে ৪০০টি ইটভাটা রয়েছে। এরমধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র রয়েছে রাজশাহী জেলার মাত্র ১৬টি ইটভাটার। বাকি তিনটি জেলার মধ্যে কোন জেলায় কতটি ইটভাটা তার সুনির্দিষ্ট তথ্য জানাতে পারেনি দপ্তরটি। এছাড়া সাড়ে ৪০০টি ইটভাটার মধ্যে কোন ক্যাটাগরির কতটি ইটভাটা সে সম্পর্কেও কোনো তথ্য সরকারি এই দপ্তরটির কাছে নেই। তবে বেসরকারি একটি সূত্র বলছে, রাজশাহী অঞ্চলে অবৈধ ইভাটার সংখ্যা আরো অনেক বেশি প্রায় ৭০০টি হবে।

ইটভাটার ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের এক কর্মকর্তা জানান, ইটভাটা থেকে নির্গত ছাই আশপাশের গাছপালা ও ফসলের মারাত্নক ক্ষতি করে। ছাই ও বস্তুকণা গাছের পত্ররন্ধ্র বন্ধ করে দেয়, উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণ ও শ্বষণ প্রক্রিয়াকে মারাত্নকভাবে ব্যাহত করে। কার্বনডাইঅক্সাইড ও সালফারডাইঅক্সাইড মিশ্রিত ছাই আম, ধান, লিচু, কাঁঠাল, শিম, কুমড়া, সরিষাসহ বিভিন্ন ফসলের রেণুকে বিনষ্ট করে থাকে। এতে ফসলের উৎপাদনও মারাত্নকভাবে হ্রাস পায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, এক ফসলি বা অনাবাদি জমিতে ইটভাটা নির্মাণ করা যায়। কিন্তু রাজশাহীর বেশিরভাগ ইটভাটা গড়ে উঠেছে দুই অথবা তিন ফসলি জমিতে।

কোনো কোনো সময় ভাটা মালিকেরা জমি কিনে নিয়ে কয়েক বছর ধরে অনাবাদি ফেলে রাখেন। পরে অনাবাদি দেখিয়ে ছাড়পত্র নেন। ভাটা মালিকেরা প্রভাবশালী হওয়ায় কৃষি দপ্তরের কিছুই করার থাকে না। তারা পার পেয়ে যান। এ নিয়ে জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি। জানতে চাইলে রাজশাহী জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মাহমুদা পারভীন জানান, সুনির্দিষ্ট নাম-ঠিকানাসহ অভিযোগ পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তবে এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তরের গাফেলতির অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।

আর রাজশাহী পরিবেশ অধিদপ্তরের অন্য কর্মকর্তারা বলছেন, জনবল সংকটে কার্যক্রম জোরদার করা সম্ভব হচ্ছে না। বিভিন্ন সময়ে চিঠি দিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়। কিন্তু সাড়া মেলেনি। তা সত্বেও স্বল্প জনবল দিয়েই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। ইট প্রস্তুতকরণ ও ভাটা স্থাপন সংক্রান্ত ২০১৩ সালের আইন অনুযায়ী জেলা প্রশাসকের অনুমোদন ছাড়া ভাটা স্থাপন ও ইট পোড়ানো নিষিদ্ধ। এ আইন লংঘনকারী এক বছরের কারাদণ্ড অথবা এক লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। কিন্তু এ অঞ্চলে এ আইন লংঘন করেই অধিকাংশ ইটভাটায় ইট বানানো ও পোড়ানো অব্যাহত রয়েছে।

তবে জেলা প্রশাসনের একটি সূত্র জানায়, লাইসেন্স নিতে ইটভাটা মালিকদের উৎসাহিত করছেন তারা। এছাড়া নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছে মাঠ প্রশাসন। অবৈধ ইটভাটা গুঁড়িয়ে দেয়াসহ আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এ প্রক্রিয়া চলমান বলেও সূত্রটি জানিয়েছে।
এ বিষয়ে রাজশাহী ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি সাদরুল ইসলাম জানান, নিবন্ধন প্রক্রিয়া বেশ দীর্ঘ এবং জটিল। মোটা বিনিয়োগের পর পুরো প্রক্রিয়া পর্যন্ত দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হবে। তাদের কেউ কেউ ছাড়পত্র না পেলেও একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে থেকেই ইটভাটা চালু করেন। তিনি বলেন, বৈধভাবেই ব্যবসা করতে চান তারা।

ভাটা মালিকেরা বলছেন, আইনি নানা জটিলতার কারণে ছাড়পত্র ও লাইসেন্স পাচ্ছেন না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ভাটা মালিক বলেন, প্রক্রিয়া জটিল ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই কোনো কোনো সময় চাঁদা দিয়ে চালাতে হচ্ছে ইটভাটা।

রাজশাহীর পবা উপজেলার ভালাম ও ভবানিপুর এবং কাটাখালি থানাধীন কুখুন্ডি এলাকায় ৪-৫টি ইটভাটা ও হরিয়ান রাস্তার পাশের একটি ইটভাটায় পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। গত তিন বছর যাবত এই ভাটায় কাঠ পোড়ানো হলেও দেখার কেউ নেই। জানা গেছে, পবা উপজেলার ভবানিপুর এলাকায় বিএএম ব্রিকস্ নামের একটি ইট ভাটা আবাসিক ও বাগান এলাকার পাশে কৃষি জমিতে গড়ে উঠেছে। এই ভাটায় তিন বছর যাবত কাঠ পুড়িয়ে ইট তৈরি করা হচ্ছে। ভাটামালিক প্রভাবশালী হওয়ায় এলাকার কেউ তাকে কিছু বলতে সাহস পাননা। অজ্ঞাত কারণে তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয় না প্রশাসন। অথচ আবাসিক এলাকা ও বাগানের পাশে কৃষি জমি নষ্ট করে ইটভাটা তৈরি করতে নিষেধ রয়েছে।

তাছাড়া ভাটায় কাঠ না পুড়িয়ে কয়লা পোড়ানোর কথা বলা হয়েছে। এসব নিয়ম অমান্যকারিদের বিরুদ্ধে ইতিপূর্বে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এলাকাবাসী জানান, এই এলাকায় কৃষি জমি ও বাগানগুলোর পাশেই কয়েকটি ইটভাটা গড়ে উঠায় জমিতে ফসল কমে গেছে ও বাগানগুলোতে তেমন ফল ধরেনা। ফলে তাদের বাধ্য হয়ে বাগানগুলো কেটে ফেলতে হচ্ছে। ভাটা বন্ধ হলে তাদের বাগানগুলো বেঁচে যেত। জমিগুলোও আবার ভরে উঠতো সোনালী ফসলে।


আরোও অন্যান্য খবর
Paris