বৃহস্পতিবার

১৮ই এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অনুমোদনহীন যানবাহনের আধিক্যে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না সড়ক দুর্ঘটনা

Paris
Update : মঙ্গলবার, ৯ মার্চ, ২০২১

এফএনএস : দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে অবাধে চলাচল করছে অনুমোদনহীন যানবাহন। ওসব যানবাহনের কারণে কোনোভাবেই সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। অভিযোগ রয়েছে, রাজনৈতিক প্রভাবে সড়ক-মহাসড়কে অবৈধ যানবাহন চলাচল করছে। অথচ সড়ক নিরাপত্তা বিধানে সরকার জনস্বার্থে ২২টি জাতীয় মহাসড়কে থ্রি হুইলার অটোরিক্সা, অটো, টেম্পো এবং সব শ্রেণীর অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচল ২০১৫ সালের ১ আগস্ট থেকে নিষিদ্ধ করেছে। তাছাড়া মহাসড়কে তিন চাকাসহ স্বল্প গতির যানবাহন চলাচল বন্ধে উচ্চ আদালতেরও রয়েছে কঠোর নির্দেশনা।

অথচ বাস্তবে তার কিছুই মানা হচ্ছে না। ফলে যা ঘটার তাই ঘটছে। এমনকি করোনা মহামারীর মধ্যে গত বছর প্রায় দুই মাস সড়কে গণপরিবহন চলাচল বন্ধ থাকলেও দুর্ঘটনা কমার কোন তথ্য মিলেনি। বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠনের হিসাবে গত বছরে সড়কে সাড়ে ৬ হাজারেরও বেশি মানুষের প্রাণ গেছে। সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ, বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি এবং পরিবহন খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশের বিভিন্ন সড়কে ১৮ লাখ নসিমন, করিমন, ভটভটি চলাচল করছে। যার একটিও সরকারিভাবে অনুমোদিত নয়। তাছাড়া ৩ লক্ষাধিক ব্যাটারিচালিত রিক্সা ও ইজিবাইক মহাসড়কে চলাচল করছে। যা নিরাপদ সড়ক বাস্তবায়ন অসম্ভব করে তুলছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, এদেশে প্রতি ১০ হাজার যানবাহনের মধ্যে ৮৬ দশমিক ৬টি যানবাহন প্রতি বছর মারাত্মক দুর্ঘটনায় পড়ছে। ওই পরিসংখ্যানে নিহতের সংখ্যা এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ ১৬৯ জন। আর দুর্ঘটনার কারণে দেশের ২ শতাংশ জিডিপি ক্ষতি হচ্ছে।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বর্তমানে ঢাকা থেকে কুমিল্লা পর্যন্ত বিভিন্ন পয়েন্টে অটোরিক্সার স্ট্যান্ড রয়েছে। সুযোগ বুঝে অনেক সময় অটোরিক্সাসহ ব্যাটারিচালিত রিক্সা ও অন্যান্য পরিবহন মহাসড়কে চলাচল করে। সব সময়ই চোখে পড়ে সোনারগাঁও পয়েন্টে অবৈধ পার্কিং, ছোট ছোট বিভিন্ন গাড়ির সারিবদ্ধ লাইন। আর ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের অন্তত ২০টি পয়েন্টে অনুমোদনহীন পরিবহন চলতে দেখা যায়। আছে প্রায় শতাধিক টার্মিনাল। টঙ্গীসহ খোদ জয়দেবপুর চৌরাস্তায় বিপুলসংখ্যক ওসব পরিবহনের দেখা মিলে। আর ইতিমধ্যে ইজিবাইক, থ্রি হুইলার জাতীয় অটোরিক্সা রেজিস্ট্রেশনের আওতায় আনার সরকারি সিদ্ধান্ত সড়ক-মহাসড়কে সঙ্কট আরো বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

সূত্র জানায়, দেশের সবকটি গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কেই নিষিদ্ধ ঘোষিত সব ধরনের যানবাহন চলাচল করছে। যা সড়ক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অন্তরায়। ওসব যানবাহন বন্ধে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) থেকে শুরু করে পুলিশের আন্তরিকতা প্রশ্নবিদ্ধ। তাছাড়া অনেক এলাকায় স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাদের সরাসরি সমর্থনে অনুমোদনহীন ওসব যানবাহন চলাচল করে। পরিবহন খাত সংশ্লিষ্টরাও সড়ক-মহাসড়কে নিষিদ্ধ পরিবহন চালু থাকায় ক্ষুব্ধ। তাদের আশঙ্কা, স্বল্পগতির পরিবহনের কারণে সড়ক দুর্ঘটনা আরো বাড়বে।

ব্যাপক প্রচার চালিয়ে সরকার ২২টি জাতীয় মহাসড়কে থ্রি হুইলার চলাচল নিষিদ্ধ করে। কিন্তু সম্প্রতি থ্রি হুইলার আর ইজিবাইক বিআরটিএ থেকে রেজিস্ট্রেন দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তাতে সড়কে আরো বেশি অরাজকতা বাড়ার আশঙ্কা বাড়ছে। যদিও সরকার সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ও দুর্ঘটনা কমাতে দেশের সবকটি মহাসড়ক পর্যায়ক্রমে চার লেনে রূপান্তর করছে। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, ওসব প্রকল্পের কাজ শেষ হলে সড়কের চিত্র পাল্টে যাবে।

সূত্র আরো জানায়, দেশের আড়াই লাখ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ২১ হাজার ৩০২ কিলোমিটার সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতরের অধীন। তার মধ্যে ৩ হাজার ৮১২ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়কে ৩ চাকা নিষিদ্ধ। তবে অন্যত্র চলতে বাধা নেই। ভবিষ্যতে মহাসড়কে ধীরগতির গাড়ির জন্য পৃথক লেন হবে। কিন্তু মহাসড়কে আর তিন চাকা ফিরবে না। হাইওয়ে পুলিশও মহাসড়কে নিষিদ্ধ পরিবহন চলাচল বন্ধ করার জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করে। তবে ওই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছাই বেশি জরুরি। কারণ সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না গেলে সকল অবকাঠামোগত উন্নয়ন ম্লান হয়ে পড়বে। সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো সড়ককে নিরাপদ করা।

সেজন্য সরকার প্রয়োজনীয় সব রকমের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে দেশের প্রধান ২২টি জাতীয় মহাসড়কে সরকার সিএনজিচালিত তিন চাকার যানবাহন, অটোরিক্সা, অটোটেম্পো ও অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করেছে। যে মহাসড়কে অটোরিক্সা ও অযান্ত্রিক যানবাহন নিষিদ্ধ করা হয়েছে সেগুলো হলোÑ এন-১ : কাঁচপুর সেতু থেকে মদনপুর-কুমিল্লা-ফেনী-চট্টগ্রাম-রামু (কক্সবাজার), এন ২ : কাঁচপুর সেতু-ঢাকা ভেলানগর (নরসিংদী)-ভৈরব-সরাইল-মাধবপুর-মিরপুর-শেরপুর-সিলেট বাইপাস, এন ৩ : জয়দেবপুর চৌরাস্তা-ময়মনসিংহ বাইপাস পয়েন্ট, এন ৪ : জয়দেবপুর চৌরাস্তা-টাঙ্গাইল-জামালপুর, এন ৫ : আমিনবাজার সেতু ঢাকা-মানিকগঞ্জ-পাটুরিয়া ঘাট-খয়েরচর ঘাট-কাশিনাথপুর-হাটিকুমরুল-বগুড়া বাইপাস-রংপুর বাইপাস-সৈয়দপুর বাইপাস-দশমাইল (দিনাজপুর)-ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড়-বাংলাবান্ধা,

এন ৬ : কাশিনাথপুর (পাবনা)-পাবনা বাইপাস-দাশুরিয়া-নাটোর বাইপাস-রাজশাহী বাইপাস-নবাবগঞ্জ-সোনা মসজিদ-বালিয়াদিঘী স্থলবন্দর, এন ৭ : দৌলতদিয়া-ফরিদপুর (রাজবাড়ী মোড়)-মাগুরা-ঝিনাইদহ বাইপাস-যশোর বাইপাস-খুলনা সিটি বাইপাস-মংলা, এন ৮ : তেগোরিয়া মোড় (ঢাকা)-মাওয়া-কাওরাকান্দি-ভাঙ্গা-বরিশাল-পটুয়াখালী। তাছাড়াও এন ১০২ : ময়নামতি (কুমিল্লা)-ব্রাহ্মণবাড়িয়া বাইপাস-সরাইল, এন ১০৫ : মদনপুর-ভুলতা-মীরের বাজার-বোগড়া-কড্ডা (ঢাকা বাইপাস), এন ৪০৫ : এলেঙ্গা-নলকা-হাটিকুমরুল, এন ৫০২ : বগুড়া-নাটোর, এন ৫০৬ : রংপুর-বড়বাড়ি-কুড়িগ্রাম, এন ৫০৭ : হাটিকুমরুল-বনপাড়া, এন ৫০৯ : বড়বাড়ি-লালমনিরহাট-বুড়িমারী, এন ৫৪০ : নবীনগর-ইপিজেড-চন্দ্রা, এন ৭০২ : যশোর-মাগুরা, এন ৭০৪ : ঝিনাইদহ-কুষ্টিয়া-দাশোরিয়া, এন ৭০৬ : চাষাড়া মোড় (যশোর)-বেনাপোল, এন ৮০৪ ও ৮০৮ : ভাঙ্গা-ফরিদপুর বাইপাস-রাজবাড়ী মোড়, এন ৮০৫ : ভাঙ্গা-ভাটিয়াপাড়া-মোল্লার হাট-ফকির হাট-নোয়াপাড়া, এন ৮০৬ : ভাটিয়াপাড়া-কালনা লোহাগড়া-নড়াইল-যশোর।

এদিকে মহাসড়কে অনুমোদনহীন যানবাহন চলাচল প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ জানান, নিষিদ্ধ হলেও দেশের বিভিন্ন হাইওয়েতে সিএনজিচালিত অটোরিক্সা চলছে। অথচ সরকার বলছে ওসব পরিবহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। সড়ক বিভাগ এ ব্যাপারে কিছু বলছে না। সবাই দেখেও না দেখার ভান করলে যাত্রীসহ পরিবহন মালিক শ্রমিকদের দুর্ভোগ কোনদিনই লাঘব হবে না। গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব মহাসড়কে অটোরিক্সাসহ অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচল করছে। একই প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ট্রাক কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির সভাপতি রস্তম আলী জানান, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বগুড়াসহ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন রুট ও চট্টগ্রাম মহাসড়কে নিষিদ্ধ পরিবহন নিয়মিত চলাচল করছে। তাছাড়া ওসব মহাসড়কে একটু পর পর বাজারসহ স’ মিলের শেষ নেই। রাস্তার ওপর রাখা হচ্ছে কাঠ। অবৈধ টার্মিনাল তো আছেই। ওসব সমস্যা দূর করতে দ্রুত সরকারের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।

অন্যদিকে বিশেষজ্ঞদের মতে, উন্নত দেশগুলোর মহাসড়কে অযান্ত্রিক কিংবা স্বল্পগতির যানবাহন চলাচলের কোন ব্যবস্থা নেই। আর এদশে অপরিকল্পিতভাবে সড়কগুলো নির্মাণ হয়েছে। অযান্ত্রিক বা স্বল্পগতির যানবাহন চলাচলের বিষয়টি মাথায় না রেখেই সড়ক হয়েছে। অথচ পৃথক লেন করে দিলেই সমস্যার সমাধান হতো। সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে সব পক্ষের আন্তমিকা জরুরি। বর্তমানে মহাখালী আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল থেকে বৃহত্তর ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ৪০টি রুটে বাস চলাচল করে। কিন্তু সকল রুটেই অটোরিক্সাসহ অনুমোদনহীন যানবাহন চলছেই। সরকারকে বারবার এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করা হলেও তাতে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।

ওসব পরিবহন চলাচলের কারণে আন্তঃজেলা রুটের পরিবহনগুলো স্বাভাবিক গতিতে চলাচল করতে পারে না। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক জানান, সড়ক দুর্ঘটনা রোধসহ নিরাপদ মহাসড়ক গড়তে তিন চাকার পরিবহন চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্ত ইতিবাচক ছিল। কিন্তু ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেট-কুমিল্লা-টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ-নরসিংদীসহ বিভিন্ন মহাসড়কে ওসব পরিবহন আবারও ফিরে এসেছে। সরকার ৬০ ভাগ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে পেরেছে। এ ব্যাপারে আরো কঠোর হলে হয়তো পরিস্থিতির উন্নতি হবে। তবে যাত্রী দুর্ভোগের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে।


আরোও অন্যান্য খবর
Paris