স্টাফ রিপোর্টার : রাজশাহী ইসলামি ব্যাংক মেডিকেল কলেজ (আইবিএমসি) ও হাসপাতালে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে বিনা নোটিশে ছাঁটাইসহ হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনার প্রতিবাদে গত সোমবার চিকিৎসা সেবা বন্ধ রেখে কর্মবিরতি পালন করেছেন চিকিৎসক-কর্মচারীরা। ফলে দুর্ভোগের মুখে পড়েন রোগী ও তাদের স্বজনরা। আইএবিএমসির সিনিয়র চিকিৎসকরা জানান, আইবিএমসি ও হাসপাতালে কর্মরত শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে সিনিয়র শিক্ষকদের নিয়ে সম্প্রতি শিক্ষক কল্যান সমিতি গঠন করা হয়েছে। অধ্যাপক মামুন উর রশিদ ওই কমিটির সভাপতি এবং অধ্যাপক মহিবুল হাসান সাধারণ সম্পাদক।
এরপর হঠাৎ করে গত বৃহস্পতিবার শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মামুনকে জানানো হয় তার চাকরি নাই। এ নিয়ে সমিতির নেতৃবৃন্দ অধ্যক্ষের সহযোগিতা চাইলে তিনি কোন সহযোগিতা করেন নি। উল্টো সোমবার প্রধান ফটকে তালা ঝুলিয়ে অধ্যাপক মামুন উর রশিদকে কলেজে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। পরে অধ্যাপক মহিবুল হাসান কলেজে প্রবেশ করে দেখেন, তার কক্ষ ও নেমপ্লেট ভাংচুর করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, অধ্যাপক মহিবুল হাসানকে জানানো হয় তারও চাকরি নাই। এ সময় শিক্ষকরা বিনা নোটিশের ছাঁটাইয়ের প্রতিবাদে বহির্বিভাগের চিকিৎসা সেবা বন্ধ করে আলোচনায় বসার জন্য গেলে কনফারেন্স রুম বন্ধ পায়।
এ সময় ভিতরে ৮ থেকে ১০ জন চিকিৎসক আটকা পড়েন বলে তারা জানান। পরে পুলিশ কমিশনারকে তারা বিষয়টি জানায়। এ সময় পুলিশ এসে পরিস্থিতি শান্ত করেন। শিক্ষকরা দাবি করে বলেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি কোন নোটিশ ছাড়াই ৭-৮ জন চিকিৎসককে ছাঁটাই করেছে। তারা বলেন-২০০৩ সালে কলেজটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৮ বছরেও কোন চাকরি বিধিমালা তৈরি হয়নি। সিনিয়র শিক্ষকদের চাকরিতে যোগদানের সময় স্বল্প সময়ের (৬ মাস) চুক্তিবন্ধ করা হয়। চুক্তির মেয়াদ খেয়াল খুশিমত নবায়ন করা হয়। নিয়োগ পত্রের শর্তানুযায়ী ১ মাসের আগাম নোটিশ ছাড়াই অসম্মাজনক ভাবে চাকরি থেকে অব্যহতি দেওয়া হয়।
উল্লেখ্য যে, বিভাগীয় সিনিয়র অধ্যাপকের স্বল্পতা থাকা সত্ত্বেও চাকরি নবায়ন করা হয় না। চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আরো জানান, আইবিএমসিতে ৬ বছর যাবত কোন বেতন স্কেল পরিবর্তন করা হয়নি। সেই জন্য শিক্ষক-কর্মচারী সবার বেতন সরকারি বেতনের চেয়ে অনেক কম। কর্মচারীরা যে বেতন পান তা এ দ্রব্য মূল্যের বাজারে নিতাস্তই অপ্রতুল। অফিস সময়ে বাইরে কর্মচারীরা কোথাও পার্ট-টাইম চাকরি করে তাদের আর্থিক সমস্যা কিছুটা হলেও সামাধান করতে পারে কিন্তু কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে চূড়ান্ত নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।
রাজশাহী আইবিএমসির বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি তুলে ধরে তারা বলেন, রাজশাহী ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে নিয়মিত নিয়োগ ও পদন্নোতি কমিটির সভা হয়না। এর ফলে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও দীর্ঘদিন যাবত একই পদে চাকরি করতে বাধ্য হন শিক্ষক-কর্মকর্তারা। ফলে তাদের মধ্যে হতাশা এবং ক্ষোভ বিরাজ করছে। শুধু তাই নয়, এর ফলে শিক্ষার মানও ক্ষুন্ন হচ্ছে। নিয়মিত নিয়োগ না হওয়ায় অনেক বিভাগে প্রয়োজনীয় শিক্ষক নেই। এতে করে শিক্ষার মান কমে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে মিড লেভেল শিক্ষকদের চাকরি নিয়মিত না হওয়ায় তারা ইনক্রিমেন্ট ও বোনাস পান না।
চাকরিতে সিনিয়র শিক্ষকদের নিয়োগের সময় বিভিন্ন শিক্ষকদের সাথে ভিন্নভাবে চুক্তি করা হয়।পরে চুক্তিকৃত বেতন ইচ্ছামত কর্তন করা হয়। যেমন এখানে নয় মাস যাবত বিভিন্ন পর্যায়ে শিক্ষকদের টেকনিক্যাল ভাতা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষকদের অর্জিত ছুটি এবং হজ্ব পালনকালীন কোন ছুটি নাই। অসুস্থ্যতাজনিত ছুটি সাত দিন। কিন্তু তা নৈমিত্তিক ছুটি শেষ হবার পরে পাওয়া যায়। মাতৃকালীন ছুটি ২ মাস। যেখনে সরকারী নিয়মানুযায়ী এ ছুটি ছয় মাস। কর্মচারীদের অর্জিত ছুটি আছে, কিন্তু অর্জিত ছুটির পরির্বতে কর্মচারীরা বছর শেষে ছুটি না কাটালে ছুটির টাকা পেত। সেটা এখন কর্তন করে ছুটি কাটাতে বাধ্য করা হচ্ছে। কর্মচারীদের ওভারটাইম ও অনকলে যে টাকা দেওয়া হয় তাও দুই বছর যাবত বন্ধ আছে।
বিক্ষুব্ধ চিকিৎসক-কর্মকর্তারা আরো বলেন, বিভাগের টিস্যু, কলম, কাগজসহ প্রত্যেকটি নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয়ের ব্যাপারে মাত্রারিক্ত হিসাব করা হচ্ছে। খালি টিস্যু বক্স ও ব্যবহৃত কলম ফেরত না দিলে নতুন টিস্যু বক্স ও কলম দেওয়া হয় না। বিভিন্ন সময়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, বিএমডিসি ও মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় কতৃক কলেজ পরির্দশনের সমস্য ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনের কোন প্রতিনিধি উপস্থিত থাকে না। এতে করে ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষ কাজের সমস্যা ও প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত অবস্থা জানতে পারে না। ফলে সমস্যা সমাধানের কোন ব্যবস্থা গ্রহন করা সম্ভব হয় না।
জানতে চাইলে ইসলামি ব্যাংক মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ আনোয়ার হাবিব বলেন-‘অফিসের গেটে তালা দেওয়া হয়নি। ছাঁটায়ের বিষয়টি মিথ্যা। মহিবুল হাসান ও মামুন অর রশিদ নামের দু’জন চিকিৎকের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তাদের সময় শেষ হওয়ায় বাদ দেওয়া হয়।’
এদিকে, বিনা নোটিশে ছাঁটাইয়ের প্রতিবাদে এবং শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিভিন্ন দাবি আদায়ের লক্ষ্যে গতকাল মঙ্গলবার বেলা ১১টায় আইবিএমসি ক্যাম্পাসের সামনে এক মানববন্ধন কর্মসূচির আয়োজন করেছে শিক্ষক কল্যাণ সমিতি। এ সময় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, রাজশাহী মহানগরের সাধারণ সম্পাদক মোঃ ডাবলু সরকারের কাছে চিকিৎসক, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা বিষয়টি অবগত করেন। তাৎক্ষনিক ভাবে মোঃ ডাবলু সরকার ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষের সাথে আলোচনার লক্ষ্যে কলেজের কনফারেন্স কক্ষে বসেন। সাধারণ রোগী সেবা নিতে যেন ক্ষতিগ্রস্থ না হয় ও চিকিৎসক ও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের বিষয়টি তুলে ধরেন।
তাকে (অধ্যক্ষকে) সমাধানের আসার জন্য নিশ্চিত করেন। অধ্যাপক মহিবুল হাসান, অধ্যাপক মামুনুর রশীদ ও অধ্যাপক লতিফুর রহমান অপু, তাদের তিন জনের পুনরায় চাকুরী অব্যাহত রাখার অনুরোধ করেন। এ সময় অধ্যক্ষ আগামী ১০ মার্চ পর্যন্ত সময় চান, ঢাকা থেকে তাদের আইবিএফ এর একটি প্রতিনিধি দল আসবে। তারা এসে সকল সমস্যার সমাধান করে দিয়ে যাবেন। মুঠোফোনে অধ্যক্ষের সাথে ডাবলু সরকারের এসব বিষয়ে আলাপ হয়। বিষয়টি চিকিৎসক, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জানানো হয়। এ সময় ডাবলু সরকার সাধারণ রোগীর চিকিৎসা সেবা পেতে কোন সমস্যা না হয় সেই লক্ষ্যে আন্দোলকারীদের কর্মসূচী স্থগিত করার জন্য অনুরোধ জানান।
আন্দোলনকারীরা একমত পোষণ করেন। তখন তারা আন্দোলন বন্ধ করে বলেন, ১০ মার্চ পর্যন্ত সমস্যার সমাধান না হলে তারা আন্দোলন আবারো শুরু করবে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক সম্পাদক ও ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধ্যাপক ডাঃ চিন্ময় দাস, অধ্যাপক সানাউল হক বকুল (শিশু বিভাগ), ডাঃ লাইলা (মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ), অধ্যাপক সাইদ আহমেদ (আর্থোপেডিক বিভাগ), অধ্যাপক ডাঃ খালেক আহমেদ (কার্ডিওলোজি বিভাগ), অধ্যাপক ডাঃ মতিউর রহমান (মেডিসিন বিভাগ), শাহ মখদুম থানার ওসি সাইফুল ইসলাম সহ একটি পুলিশের টিম।