এফএনএস : সিএনএস লিমিটেড চুক্তি ছাড়াই শুধুমাত্র মৌখিক অনুমোদনে রেলের কোটি কোটি টাকার টিকিট বিক্রি করছে। বিগত ২০০৭ সাল থেকে রেলের টিকিট বিক্রির দায়িত্ব পালন করছে সিএনএস লিমিটেড। কিন্তু সিএনএস-এর সাথে রেলের চুক্তির মেয়াদ গত বছরের মার্চেই শেষ হয়ে গেছে। আর বৈধ কোনো চুক্তি না থাকায় রেলওয়ে সিএনএসকে টিকিট বিক্রির কোনো বিল দিতে পারছে না। তাতে একদিকে যেমন সরকার অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে বৈধ চুক্তি না থাকায় সরকার এবং যাত্রী উভয়েই অর্থনৈতিক ঝুঁকিতে পড়ছে।
কারণ এমন অবস্থায় যাত্রীদের প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। ফলে যাত্রী দুর্ভোগ বাড়ার পাশাপাশি বাংলাদেশ রেলওয়ের সেবার মানও নিম্নমুখি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাতে ক্ষুন্ন হবে সরকারের ভাব-মর্যাদাও। রেলপথ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সিএনএসের সঙ্গে রেলের টিকিট বিক্রির চুক্তিতে রেলের নিজস্ব লোকবলকে প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি তা করেনি। বিগত ২০১২ সালে চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে সিএনএস নতুন করে সময় বাড়াতে আবেদন করে। কিন্তু তাতে আপত্তি জানালে প্রতিষ্ঠানটি রেলপথ মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে উল্টো মামলা করে।
পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটি নানা কৌশলে এ সময় ৩ মাস করে প্রায় ছয় মাস মেয়াদ বাড়ায়। পরে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে নতুন করে আরো দুই বছরের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়। বিগত ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ওই চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। পরে কোম্পানিটির সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ রেলওয়ে আরো এক বছর বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়। কিন্তু সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি তা মাত্র ৬ মাস বৃদ্ধি অনুমোদন করে। যা ২০২০ সালের মার্চে শেষ হয়ে গেছে। তার পর থেকে চুক্তি ছাড়াই রেলের টিকিট বিক্রি করছে সিএনএস। সূত্র জানায়, রেলের টিকিট বিক্রির সুবাদে সিএনএস-এর বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে ঈদের সময় ট্রেনে যাত্রীর চাপ বাড়লেই অজ্ঞাত কারণে সিএনএস-এর সার্ভার বিকল হয়ে যেতো। তাছাড়া টিকিট বিক্রিতেও নানা অনিয়ম-দুর্নীতি ধরা পড়েছে।
বর্তমান রেলমন্ত্রী দায়িত্ব নেয়ার পর ওসব অনিয়মের অভিযোগের প্রেক্ষিতে সিএনএস-এর চুৃক্তির মেয়াদ আর বাড়ানো হবে না বলে ঘোষণা দেন। ওই প্রেক্ষিতে রেলওয়ে সিএনএস-এর সাথে চুক্তির মেয়াদ আর না বাড়িয়ে নতুন করে দরপত্র আহবান করে। বিগত ২০১৯ সালেই রেলের টিকিট বিক্রির জন্য নতুন অপারেটর নিয়োগের কার্যক্রম শুরু করা হয়। কিন্তু করোনার কারণে তা কিছুটা পিছিয়ে গেলেও গত বছর শেষ দিকে ওই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। সেক্ষেত্রে কাজ পায় ‘সহজ’। কিন্তু দরপত্র মূল্যায়ন প্রক্রিয়া যথাযথ হয়নিঅভিযোগ এনে এর বিরুদ্ধে সিপিটিইউতে (সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট) আবেদন করে সিএনএস। তাছাড়া হাইকোর্টে রিট করলে পুরো প্রক্রিয়ার ওপর স্থগিতাদেশ দেন হাইকোর্ট।
ফলে নতুন অপারেটরও নিয়োগ দিতে পারছে না রেলওয়ে। এমন অবস্থায় সিএনএস অবৈধভাবে চুক্তি ছাড়াই শুধু মৌখিক অনুমোদনের মাধ্যমে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সূত্র আরো জানায়, বিগত ২০০৭ সালে রেলের টিকিট বিক্রিতে প্রথম দফা সিএনএসের সঙ্গে ৯ কোটি ৯১ লাখ টাকায় চুক্তি হয়। ৬০ মাস মেয়াদি ওই চুক্তির মেয়াদ শেষ হয় ২০১২ সালে। তবে ট্রেনের সংখ্যা বৃদ্ধি, স্টপেজ বৃদ্ধি, কোচ ও আসন বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে ৬০ মাস শেষে চুক্তি মূল্য দাঁড়ায় ১৩ কোটি ৮ লাখ টাকা। তবে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদনক্রমে চুক্তির মেয়াদ ২ বছর বাড়ানো হয়।
পরবর্তীতে দরপত্র আহ্বান করা হলে আবারও কাজ পায় সিএনএস। ২০১৪ সালের অক্টোবরে ৬০ মাসের জন্য এ-সংক্রান্ত চুক্তি করা হয়। ওই সময় চুক্তিমূল্য ছিল ৩১ কোটি ৩২ লাখ টাকা। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ওই চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল। যদিও ট্রেনের সংখ্যা বৃদ্ধি, স্টপেজ বৃদ্ধি, কোচ ও আসন বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে ৬০ মাস শেষে চুক্তি মূল্য দাঁড়ায় ৪১ কোটি ৯০ লাখ টাকা। নতুন অপারেটর নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়ায় ওই সময়ও সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে রেলওয়ে ২০ শতাংশ বা ১২ মাস চুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব পাঠায়।
কিন্তু ওই প্রস্তাব নিয়েই তৈরি হয় জটিলতা। ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি মতামত দেয়, চুক্তির ক্ষেত্রে মেয়াদের পরিবর্তে মূল্য বিবেচনা করতে হবে। এতে চুক্তিমূল্য ৩১ কোটি ৩২ লাখ টাকা ৪২ মাস তথা ২০১৭ সালের ডিসেম্বরেই শেষ হয়ে গেছে। তাতে চুক্তিমূল্য সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ তথা ১৫ কোটি ৬৬ লাখ টাকার আনুপাতিক চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। ফলে বর্ধিত চুক্তির মূল্য দাঁড়ায় ৪৬ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। ওই হিসাবে অবশিষ্ট চুক্তিমূল্য ছিল ৫ কোটি ৮ লাখ টাকা।
বর্ধিত এ চুক্তিমূল্য দিয়ে আর মাত্র ৬ মাস চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো যায় বলে মতামত দেয় মন্ত্রিসভা কমিটি। যা গত বছর মার্চে শেষ হয়ে গেছে। তারপর থেকেই চুক্তি ছাড়া রেলের টিকিট বিক্রি করে যাচ্ছে সিএনএস। মূলত রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের মৌখিক নির্দেশে এ কাজ করে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।