শুক্রবার

২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষর্থীদের আগ্রহ কম, বেসরকারিতে বেশি

Paris
Update : শনিবার, ১৬ জানুয়ারি, ২০২১

এফএনএস : দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কয়েক বছর ধরে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এতে আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিং থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পিছিয়ে পড়ছে। গতানুগতিক সিলেবাস, অবকাঠামো ও আবাসন সঙ্কটের কারণে বিদেশিরা আসতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ চিত্র উল্টো। প্রতি বছর বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। শিক্ষার্থীদের জন্য আধুনিক সুবিধা ও পরিবেশ নিশ্চিত করায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশিরা আসতে আগ্রহী হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ ৪৬ তম বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৯ সালে দেশের শিক্ষা কার্যক্রম চলমান ৪৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ২০টিতে ৪৮২ জন বিদেশি শিক্ষার্থী রয়েছে। ২০১৮ সালে এ সংখ্যা ছিল ৮০৪।

অন্যদিকে ১০৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৪০টিতে ভর্তি হয়েছে ১ হাজার ৯৪৯ জন। সে তুলনায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। ইউজিসির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত এক দশকের মধ্যে ২০১০ সালে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৫৯ জন, ২০১১ সালে ২১০ জন, ২০১২ সালে ৫২৫ জন, ২০১৩ সালে ৩২৬ জন, ২০১৪ সালে ৪৩২ জন, ২০১৫ সালে ৫৯৩ জন, ২০১৬ সালে ৩৫৫ জন, ২০১৭ সালে ৪৬২, ২০১৮ সালে বেড়ে তা ৮০৪ জন ভর্তি হয়েছে। তবে এর পরের বছর ২০১৯ সালে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি প্রায় অর্ধেকে নেমে ৪৮২ জনে দাঁড়িয়েছে।

অন্যদিকে, গত ৫ বছরের হিসাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় সব বছর বিদেশি শিক্ষার্থী বেড়েছে। তার মধ্যে ২০১৫ সালে ১ হাজার ৫৪৮ জন, ২০১৬ সালে ১ হাজার ৯২৭ জন, ২০১৭ সালে ১ হাজার ৯৭৭ জন, তবে ২০১৮ সালে হলি আর্টিসানে জঙ্গি হামলার ঘটনায় সে বছর শিক্ষার্থী সংখ্যা তুলনামূলক হারে কমে গিয়ে ১ হাজার ৩৮৬ হয়। অবশ্য পরে তা বেড়ে ১ হাজার ৪৬৭ জনে দাঁড়ায়। ২০১৯ সালে বাংলাদেশের ৪০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশিরা স্নাতক-স্নাতকোত্তর ডিগ্রিতে পড়াশোনা করতে আসে। তার মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), ফিলিপাইন, মিয়ানমার, জিম্বাবুয়ে, জাম্বিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, পাকিস্তান ও ভারতের শিক্ষার্থী রয়েছে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান বলেন, আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিংয়ে যেতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থী ও বিদেশি ফ্যাকাল্টি মেম্বার থাকাটা অধিক গুরত্বপূর্ণ। নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার কারণে আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে বিদেশি শিক্ষার্থীরা আগ্রহ হারাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, বিদেশি শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে হলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আন্তর্জাতিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। বাজেট অনেক বলে আমাদের পক্ষে সেসব সুবিধা নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বহন করলেও শিক্ষার মানের দিকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। তবে আমরা বিশ্ব মানের শিক্ষা বাস্তবায়নে মাত্র যাত্রা শুরু করেছি।

ঢাবি উপাচার্য বলেন, সামগ্রিক সুন্দর পরিবেশ বিদেশি শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ বাড়ায়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষক নিয়োগ, আবাসন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলে বিদেশি শিক্ষার্থীরা আসতে আগ্রহ পারে। এর ফলে বিশ্ব র্যাংকিংয়ে আমরা এগিয়ে যাবো। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, বিদেশি শিক্ষার্থী কম থাকায় বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্ব র্যাংকিংয়ে পিছিয়ে পড়ছে। তারা না আসলে মনে করতে হবে আমরা একঘরে হয়ে যাচ্ছি। তারা আমাদের ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলছে মনে করতে হবে। তিনি আরও বলেন, আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চরম ক্লাস রুম সঙ্কট রয়েছে। একটি ক্লাসে ১৬০ জন পড়ানো হচ্ছে।

শিক্ষার্থীদের চাপে ক্লাসের পরিবেশ বজায় থাকে না। চরমভাবে আবাসন ও খাবার সঙ্কট রয়েছে। বিদেশিরা এসব মেনে নিতে পারে না। ঢাকা মহানগরে এমন পরিস্থিতি, ঢাকার বাইরে এ সমস্যা আরও বেশি। সমাধান হিসেবে এই শিক্ষাবিদ বলেন, সেমিস্টার অনূযায়ী স্বল্প সময়ে সিলেবাসের চাপে ভালো ফলাফল পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। জ্ঞান-বিজ্ঞানে গবেষণা, লাইব্রেরি ও জার্নাল সম্প্রসারণ ও শিক্ষার্থীদের বৃত্তি সুবিধা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের খাবারের জন্য মানসম্মত ক্যাফেটোরিয়া তৈরিসহ আধুনিক সকল সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। এদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদনে সাধুবাদ জানানো হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, প্রতিবছরই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর কারণ, বর্তমানে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যাপক ডিজিটালাইজেশন হয়েছে। ফলে বিদেশি শিক্ষার্থীরা তথ্য ও প্রযুক্তির মাধ্যমে বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে উচ্চশিক্ষার কোর্স-কারিকুলাম, সিলেবাস ইত্যাদি দেখে বাংলাদেশে পড়ার জন্য উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। প্রতিবেদন থেকে আরও জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, চীন, কানাডার মতো উন্নত দেশগুলো থেকেও শিক্ষার্থীরা পড়তে আসছে। সে কারণে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলের পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের হারও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এ ধারা অব্যাহত রাখতে শিক্ষার গুণগতমান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আরও উন্নীত করা প্রয়োজন বলেও মত প্রকাশ করা হয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি বিদেশি শিক্ষার্থীদের এমন আগ্রহের বিভিন্ন কারণ তুলে ধরেছেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আতিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমরা প্রতিটি শিক্ষার্থীদের আলাদাভাবে কেয়ার করে থাকি। আমাদের ডিগ্রি নিয়ে কেউ বেকার থাকতে হচ্ছে না। এখানে সেশনজট নেই। যারা আধুনিক সুবিধা নিশ্চিত করতে পারছে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশিরা পড়তে আগ্রহী হচ্ছে। মানসম্মত সিলেবাস ও বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নানাবিধ সুবিধা তৈরি করা হয়েছে। নিজ তহবিল থেকে গবেষণায় কার্যক্রমের সুযোগ তৈরি করে দেয়া হচ্ছে।

অধ্যাপক আতিকুল বলেন, ঢাকায় হলি আর্টিসানের ঘটনার কারণে বিদেশিরা বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। এতে সে বছর শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে গেলে বর্তমানে করোনা পরিস্থিতির করণে সেই ট্রেন্ড (প্রবণতা) থেকে গেছে। বর্তমান সঙ্কট কেটে গেলে বিদেশি শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বেড়ে যাবে। ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক কাজী শহীদুল্লাহ বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়লেও সে তুলনায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বাড়ছে না।

বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য তেমন কোনো প্রচার-প্রচারণা করে না। এ ছাড়া যেসব দেশে একসময় উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না সেসব দেশে এখন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হচ্ছে, ফলে ওইসব দেশ থেকে শিক্ষার্থী আসতে চাচ্ছে না। পাশাপাশি দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আসন সীমিত ও নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা থাকায় বিদেশি শিক্ষার্থীরা আসতে চাইতে চাইলেও সুযোগ পাচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।


আরোও অন্যান্য খবর
Paris