বৃহস্পতিবার

২৮শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

১৪ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

মহাসড়কগুলোতে ডাকাত ও ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য

Paris
Update : মঙ্গলবার, ৫ জানুয়ারি, ২০২১

এফএনএস : দেশের মহাসড়কগুলোতে অহরহ ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনায় পরিবহন শ্রমিক ও যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক বাড়ছে। বর্তমানে মহাসড়কগুলোতে দিন দিন ডাকাত ও ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম দিন দিন বেড়েই চলেছে। বেশ কিছুদিন যাবত কোনো না কোনো মহাসড়কে অহরহ ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। ডাকাত চক্রের কবল থেকে রক্ষা পাচ্ছে না পণ্যবাহী গাড়ি থেকে শুরু করে যাত্রীবাহী বাস, কার, মাইক্রোবাস, সিএনজি অটোরিকশার চালকরাও।

তবে শিল্পকারখানার পণ্যবাহী গাড়িসহ রাতে চলাচলকারী নাইটকোচ ও নতুন ব্যান্ডের গাড়িগুলোর প্রতি ডাকাতদের সবচেয়ে বেশি টার্গেট। বিভিন্ন এলাকায় কিছুদিন পর পরই হানা দিচ্ছে ডাকাতদল। যদিও পুলিশ বলছে, ডাকাতি রোধে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে। কিন্তু অপ্রতিরোধ্য ওসব ডাকাত চক্র আগ্নেয় ও ধারালো অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে নিত্যনতুন কৌশলে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে ডাকাত আতঙ্কের কারণে খুবই জরুরি প্রয়োজন ছাড়া রাতে পরিবারসহ মহাসড়কে চলাচল একেবারে কমে গেছে। পরিবহন খাত সংশ্লিষ্টদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, মহাসড়কে চলাচলকারী চালকসহ ভুক্তভোগীদের তথ্যানুযায়ী মহাসড়কের বিভিন্ন অংশে ইদানীং ডাকাতি বেড়েছে। ডাকাতদের খপ্পরে পড়ে যাত্রীরা সর্বস্ব হারাচ্ছে, কখনো কখনো আহতও হচ্ছে। কিন্তু জেলা পুলিশের সঙ্গে হাইওয়ে পুলিশের সমন্বয়হীনতার কারণে ভুক্তভোগীরা কোনো ধরনের প্রতিকার পাচ্ছে না। মহাসড়কের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পয়েন্টে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ক্যাম্প না থাকা এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের স্বল্পতার কারণেই বেশিরভাগ ডাকাতির ঘটনা ঘটে। ভুক্তভোগীদের মতে, মহাসড়কে ডাকাত রুখতে পুলিশকে আরো দায়িত্বের সঙ্গে তৎপরতা বাড়াতে হবে।

অতিসম্প্রতি ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের মির্জাপুরে মালবাহী ট্রাকে ডাকাতির পর চালককে হত্যা করে ডাকাতরা ব্রিজের নিচে লাশ ফেলে যায়। ওই সময় ট্রাকের হেলপারও আহত হয়। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের মির্জাপুর উপজেলার পুষ্টকামুরী বাইপাস ব্রিজ নামক স্থানে এ ঘটনা ঘটে। দিনাজপুর থেকে পাথরভর্তি ট্রাকটি মির্জাপুর উপজেলার পুষ্টকামুরী বাইপাস ব্রিজে এলে ৪-৫ জনের ডাকাত দল হানা দিয়ে চালক ও তাকে জিম্মি করে মারপিট শুরু করে। ওই সময় ডাকাত দলের সদস্যরা টাকা ও মালামাল লুটে নিয়ে চালককে হত্যার পর ব্রিজের ওপর থেকে ফেলে দেয়।

সূত্র জানায়, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে এখন ডাকাত-ছিনতাইকারীদের রাজত্ব। মহাসড়কটির আবদুল্লাহপুর-টঙ্গী থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার এলাকা ডাকাত ও ছিনতাকারীরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। যানজটে মহাসড়কেই প্রায়ই ছিনতাই-ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। অভিযোগ রয়েছে ডাকাত-ছিনতাকারীর দৌরাত্ম বাড়লেও মহাসড়কে দায়িত্বে থাকা পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। অথচ ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক দিয়ে প্রতিদিন লাখো মানুষ রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় যাতায়াত করছে। ওই পথে যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যাত্রীদের বসে থাকতে হয়। আর ওই সুযোগে সাধারণ মানুষের ওপর সংঘবদ্ধ দল ঝাঁপিয়ে পড়ে।

গত ১১ ডিসেম্বর রাতে দাউদকান্দির পাথর ব্যবসায়ী একরামুল ইসলাম টঙ্গী যাবার পথে একদল ছিনতাইকারী তার গাড়িতে হামলা করে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে লুটে নেয় নগদ দেড় লাখ টাকাসহ দুইটি দামি ব্রান্ডের মোবাইল। তাছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কেও আশঙ্কাজনক হারে দিনে এবং রাতে ডাকাত ও ছিনতাইকারীর উৎপাত বেড়েছে। কখনো গাড়িতে যাত্রীবেশে কখনো বা প্রাইভেটকার ও মারুতি মাইক্রোবাসে সংঘবদ্ধ ওসব চক্রের কবলে পরে অনেকেই সর্বশান্ত হচ্ছে। গত কয়েক মাসে এমন বেশ কিছু অভিযোগ শোনা গেলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা অভিযোগ বা মামলা করেনি। তাতে করে দিন দিন মহাসড়কে ছিনতাই ডাকাতিসহ অনাকাঙ্খিত ঘটনা বেড়েই চলেছে।

সূত্র আরো জানায়, ডাকাতদের সঙ্গে মহাসড়কে চলাচলরত কতিপয় পণ্যবাহী গাড়িচালক ও সহকারীর যোগসাজশ রয়েছে। ওসব পরিবহন কর্মী পণ্য নিয়ে রওনা দেয়ার আগেই মোবাইল ফোনে ডাকাতদের তথ্য জানিয়ে দেয়। ডাকাত দলের সদস্যরা নিরাপদে অবস্থান নিয়ে মহাসড়কে ব্যারিকেড তৈরি করে ডাকাতি করে। ডাকাত দলে ১০ থেকে ১৫ জন অংশ নিয়ে ২-৩টি দলে বিভক্ত হয়ে মুখোশ পরে ডাকাতি করে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে প্রতিদিন ৩০-৩৫ হাজারেরও বেশি যানবাহন চলাচল করে। কিন্তু ওই মহাসড়কে পুলিশের অপ্রতুল টহলের সুযোগ নিচ্ছে ডাকাতরা। বর্তমানে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ওই মহাসড়কে চলাচলকারী যানবাহনগুলো ৬-৭টি ডাকাত চক্রের হাতে জিম্মি।

বিশেষ করে কুমিল্লার চান্দিনা ও ফেনীর লালপুল থেকে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডের কুমিরা পর্যন্ত ৭টি পয়েন্টে বেশিরভাগ ডাকাতির ঘটনা ঘটে। ডাকাতরা মালামাল ভর্তি ট্রাক, কাভার্ডভ্যান চালকদের হাত-পা বেঁধে, কখনো হত্যা করে, আবার কখনো অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে সর্বস্ব লুটে নেয়। কখনো চলন্ত গাড়ির সামনে গাছ ফেলে বা কোন কিছু দিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে নগদ টাকাসহ মূল্যবান মালামাল ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনাও ঘটে। ওসব ঘটনায় কেউ কেউ অভিযোগ করলেও অনেকে হয়রানি এড়াতে পুলিশের দ্বারস্থ হয় না। তাছাড়া মহাসড়কে যখন যানজট বাড়ে তখনই ছিনতাই ও ডাকাতির তৎপরতাও বেড়ে যায়। হাইওয়েতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাব থাকায় ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা বেশি ঘটে। তাছাড়া বেশিরভাগ সময় ডাকাত চক্র ধরা ছোয়ার বাইরে থাকায় তারা আরো সাহসী হয়ে ওঠছে।

এদিকে গত ২২ আগস্ট ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ডাকাতির প্রস্তুতিকালে ডাকাতি কাজে ব্যবহৃত দেশিয় অস্ত্রসহ আন্তঃজেলা ডাকাত চক্রের ৮ সদস্যকে র‌্যাব-১১ গ্রেফতার করে। ঢাকা-চট্টগ্রামের মতো ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কেও প্রায় সময় ডাকাতির ঘটনা ঘটে। সশস্ত্র ডাকাতদের দখলে ঢাকা-ময়মনসিংহের ভৈরবের কালিকাপ্রসাদ থেকে কুলিয়ারচরের নোয়াগাঁও-ছয়সূতি, দ্বারিয়াকান্দি থেকে বাজরার মাঝামাঝি অঞ্চলটি। ওসব সড়কে চলাচলকারী জ্বালানিবাহী ট্যাংক লরি, মালবাহী ট্রাকে বেশি ডাকাতির ঘটনা ঘটে। একইভাবে ঢাকা-রাজশাহী, ঢাকা-সিলেটসহ অন্যান্য অঞ্চলের মহাসড়কগুলোতে ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে চলছে।

গত ২০ নভেম্বর টাঙ্গাইলের মির্জাপুর থানা পুলিশ ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে অভিযান চালিয়ে আন্তঃজেলা অজ্ঞান পার্টির ৬ সদস্যকে গ্রেফতার করে। তাদের কাছ থেকে নেশাজাতীয় দ্রব্য উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কসহ দেশের বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে যাত্রীবাহী বাসে ফেরি করে অস্বাস্থ্যকর হালুয়া বিক্রি করে। তারা কৌশলে যাত্রীদের নেশাজাতীয় দ্রব্য মেশানো ওষুধ সেবন করায়। যাত্রী অজ্ঞান হলে টাকা ও মূল্যবান জিনিসপত্র লুটে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে।

অন্যদিকে এ বিষয়ে গাজীপুর ট্রাফিক পুলিশের মহাসড়কে দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন জানান, জনবহুল গাজীপুরে বিভিন্ন দূরপাল্লার গাড়ি এসে রাতে অবস্থান নেয়। ওসব দূরপাল্লার গাড়ির হেলপাররা সংঘবদ্ধ হয়ে ছিনতাইসহ নানা অপরাধ করে আসছে বলে অভিযোগ রয়েছে। মহাসড়কে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার জন্য সব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি এলাকায় অভিযান চালিয়ে ছিনতাইকারীদের গ্রেফতারও করা হয়েছে বলে তিনি জানান।

এ প্রসঙ্গে পূর্বাঞ্চল হাইওয়ে পুলিশ সুপার নজরুল ইসলাম জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ডাকাতিতে নতুন কয়েকটি চক্র সক্রিয়। চান্দিনা, ভবেরচর ও সোনারগাঁও ওই তিন এলাকায় ডাকাতি বেশি হচ্ছে। এ বিষয়ে পুলিশ কাজ করছে। হাইওয়ে পুলিশ চালক, পথচারী ও যাত্রীদের সচেতনতায় লিফলেট বিতরণসহ নানা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি এড়াতে সচেতনতার বিকল্প নেই। অপরিচিত প্রাইভেট কার বা গাড়িতে না ওঠাই উত্তম। মহাসড়কে দুর্ঘটনাসহ অনাকাঙ্খিত ঘটনা এড়াতে বেশকিছু স্পটে দিনে রাতে হাইওয়ে পুলিশের টহল জোরদার করা হয়েছে।


আরোও অন্যান্য খবর
Paris