শুক্রবার

২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

বাউন্ডুলে জীবন পিছনে ফেলে সফল উদ্যোক্তা হতে চায় বিজয়

Paris
Update : বুধবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০২০

স্টাফ রিপার্টার : বাউন্ডুলে জীবনকে পিছনে ফেলে বিজয় এখন চায় একজন সফল উদ্যোক্তা হতে। ‘লাইফ প্রকল্প’ তাকে সেই পথের দিশা দিয়েছে। বিজয় (১৭) এর পিতা মো: জাফর আলী (৬২) ও মাতা মোসা: সখিনা বেগমের (৪৭)। রাজশাহী মহানগরীর রাজপাড়া থানার উত্তর মহিষবাথান মহল্লায় বাস করে। তার পরিবারে মোট ৫ জন সদস্য। কারিতাসের লাইফ প্রকল্পের একজন সদস্য সে। এর আগে সে ২০১৪ সালে মহিষবাথান কলোনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২য় শ্রেণিতে পড়ত। মহল্লার অন্যান্য ভবঘুরে ছেলেদের সাথে ঘুরে বেড়ার কারণে সে নিয়মিত স্কুলে যেত না।

ফলে বছরের মাঝামাঝি সময়ে লেখাপড়া থেকে ঝরে পড়ে সে। সারা দিন ভবঘুরে ছেলেদের সঙ্গে কোর্ট স্টেশনে খেলত আর টিভিতে ছবি দেখে সময় কাটাত। মা-বাবার কথাও শুনত না। তবে অনিচ্ছায় বিজয় বাবার মারের ভয়ে মাঝে মধ্যে তার মাকে বড় বড় হাড়ি পাতিল ও থালা ধুতে সাহায্য করত। সে স্কুলে যেতে চাইত না। অন্যান্য দুষ্ট প্রকৃতির ছেলেদের সাথে দিন দিন বাউন্ডেলে জীবন যাপন শুরু করে। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে লাইফ প্রকল্প ২য় ধাপের কাজ শুরু করে। জরিপের মাধ্যমে বিজয়কে ঝরে পড়া শিশু হিসেবে লাইফ প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

কারিতাসের এই লাইফ প্রকল্পের লক্ষ্য হলো, রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের পথশিশুদের জীবনমান সহনশীল ও সুরক্ষিত করা। এই প্রকল্পের একটি গুরুত্বপুর্ণ কাজ ছিল উন্মুক্ত বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয় হলো যে সমস্ত শিশু স্কুল থেকে ঝরে পড়ে, নিয়মিত স্কুলে যায় না তাদেরকে সুন্দর করে বিনোদনের মাধ্যমে অক্ষর জ্ঞান দান করে ফরমাল স্কুলে ভর্তি করানো ও ঝরে পড়া রোধ করা। এই উন্মুক্ত বিদ্যালয়ে কেজি, ১ম ও ২য় শ্রেণির ছেলে-মেয়েদেরকে ভর্তি করা হয়। মো: বিজয়কে ২য় শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়। বিজয়কে প্রকল্পের স্টাফগণ লেখাপড়ার পাশাপাশি কাউন্সিলিং করতে থাকেন। লেখাপড়া করার জন্য শিক্ষা উপকরণ সরবারহ করা হয়। মাসে ২ বার চিত্রাঙ্কন ক্লাশ করানো হয়।

মাসিক শিশু মিটিং, শিশু ওয়ার্কশপ, শিশু দিবসে, বার্ষিক ক্রিড়া প্রতিযোগিতা, বার্ষিক বনভোজন ও বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি দিবস উদযাপনে অংশগ্রহণ করানো হয়। লাইফ প্রকল্প অফিসে শিশু বান্ধব নিলয়ে অংশগ্রহণ করানো হয়। শিশুবান্ধব নিলয়ে বিনোদনের পাশাপাশি তাকে নৈতিক শিক্ষা প্রদান করা হয়। ফলে তার আচরণের পরিবর্তন হতে থাকে। সে বড়দেরকে সালাম দেয়, ছোটদেরকে স্নেহ করে। সে ছবি আঁকতে মনোযোগী হয়ে পড়ে। অনেক সুন্দর ছবি আঁকতে পারে। তার বাবা রাতে পাহারাদার ও দিনে কোর্ট স্টেশনে ছোট একটি দোকান চা-বিস্কুট বিক্রি করে মাসে ৪,০০০ টাকা আর মা ডেকোরেটরের দোকানে হাড়ি পাতিল মাজার কাজ করে মাসে, ১৫০০ টাকাসহ মা-বাবা ২ জনে মোট ৫,৫০০ টাকা আয় করে। তা দিয়ে অতিকষ্টে ৫ জনের সংসার চলত।

বিভিন্ন সময়ে তার অভিভাকদের সাথে যোগাযোগ করা হয়। লাইফ প্রকল্পের কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত করার জন্য পিতা -মাতাকে উদ্বুদ্ধ করা হয়। লাইফ প্রকল্পের বিভিন্ন কার্যক্রমে তার মা অংশগ্রহণ করে। ফলে জানতে পারে লাইফ প্রকল্প শিশুদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য কাজ করে। মুলধন সহায়তার সুযোগ আছে। তার মা তার বাবার সাথে পরামর্শ করে মুলধন সহায়তার জন্য আবেদন করে। তার পারিবারিক আর্থিক অবস্থা দেখে লাইফ প্রকল্প চা-বিস্কুট এর ব্যবসার জন্য তাকে ১৭/১২/২০১৮ তারিখে ১০,০০০ টাকা সহায়তা করা হয়। বর্তমানে সে রাজশাহী কোর্ট স্টেশনে একটি চা স্টল দিয়ে ব্যবসা করছে। সে বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে ৪,০০০ টাকা থেকে ৪,৫০০ টাকা বিক্রি করে।

তার লাভ হয় প্রতিদিন ৫০০-৬০০ টাকা বা মাসে ১৫,০০০ থেকে ১৮,০০০ টাকা। সে বখাটে ছেলেদের সঙ্গে এখন আর সময় নষ্ট করছে না। মাকে অবসর সময়ে পরিবারে সহায়তা করছে। খারাপ গালিগালাজ করেনা। তার ব্যবহার দেখে অনেক মানুষ কার কাছে যায়। তার এই আয় দিয়ে গোটা পরিবার চলছে। ভবিষতে একজন ভালো ব্যবসায়ি হিসেবে গড়ে উঠার স্বপ্ন দেখছে।

বিজয় জানায়, ‘কারিতাস লাইফ প্রকল্প আমাকে লেখাপড়া করার জন্য অনেক চেষ্টা করেছে। আমার জীবনের পরিবর্তন করেছে। আমি লেখাপড়া না শিখলেও আমার দোকানের যাবতীয় হিসাব নিকাশ করতে পারি। মানুষের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় তা আমি শিখেছি।’ বিজয়ের মা সখিনা বেগম জানান, ‘আমার ছেলের সুন্দর আচরণের জন্য লাইফ প্রকল্প যা করেছে আমি তার জন্য চিরকৃতজ্ঞ থাকব। আমি এখন আর হাড়ি-পতিল মাজার কাজ করি না। বাড়িতে সংসারের কাজের পাশাপাশি ৪টি ছাগল ও ১টি গরু দেখাশুনা করি। আমার ছেলের জন্য সবাই দোয়া করবেন।’


আরোও অন্যান্য খবর
Paris