স্টাফ রিপোর্টার : রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের ৫নং ওয়ার্ডের কোর্ট স্টেশনসংলগ্ন ছোট একটি ঘনবসতি মহল্লা উত্তর মহিষবাথান। সেখানে বসবাস করে পথশিশু শ্যামলী খাতুন (১৭)। সেই শ্যামলী এখন দারিদ্রের শত বাধা উপেক্ষা করে বড় কিছু হওয়ার স্বপ্ন দেখে।
তাদের নিজস্ব জমিজমা বলতে কিছুই নেই। তারা রেলের মাটির উপরে কোন রকমে টাটির বেড়া দিয়ে একটি কক্ষে বসবাস করে। পিতা মজিবুর রহমান (৪৮), মাতা সুলেখা বেগম (৪১)। তাদের পরিবারে মোট ৪ জন সদস্য। মা, বাবা এবং ছোট ভাই মোঃ শামীম (১১) ও সে নিজে। মোঃ শামীম সরকারী কলোনী প্রাথমিক স্কুলে ৪র্থ শ্রেণিতে পড়াশোনা করে। শ্যামলীর বাবা একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তি। বন্ধুদের প্রভাবে পড়ে ১৪-১৫ বছর যাবৎ মাদকের সাথে জড়িত। পেশায় রিক্সাচালক হলেও ঠিকমত কোন কাজ কর্ম করে না। তার স্ত্রী সুলেখা বেগম একাই বাসা বাড়িতে কাজ করে সংসার চালায়।
মাসে ৩,৫০০/- টাকা পায়। তা দিয়ে কোন রকমে খেয়ে না খেয়ে সংসার চলে। কোন কোন সময় দিনে একবারও খাওয়া হয়। অনেক সময় তার মা যে বাসায় কাজ করে সেখান থেকে খাবার নিয়ে এসে নিজে ও সন্তানদের খাওয়ায়। তার বাবা মাদক সেবনের জন্য তার মার কাছে টাকা চাইত। ফলে এই নিয়ে প্রায়ই পরিবারে অশান্তি লেগে থাকত। শ্যামলী খাতুন ছোট বেলা থেকে পরিবারে অভাব, অনটন, অশান্তি দেখেছে। ফলে সে সব সময় হতাশায় ও পথে ঘুরে বেড়িয়ে দিন কাটাত। কারও সাথে মিশত না। একা একা থাকতে পছন্দ করত।
অসহায় শ্যামলী খাতুন অনাহারে, অর্ধাহারে দিন কাটাতো। মাঝে মাঝেই তার মাকে অন্যের বাড়ির কাজে সাহায্য করতে হতো। তার মা তাকে স্কুলে ভর্তি করলেও সে নিয়মিত স্কুলে না গিয়ে রেল লাইনের ধারে ও স্টেশন নোংরা কাপড় পরে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খেলাধূলা করত ও ঘুরে বেড়াত। এরই মধ্যে ২০১৩ সালে কারিতাস লাইফ প্রকল্প রাজশাহী শহরে পথশিশুদের নিয়ে কাজ শুরু করে। সে সময় জরিপের মাধ্যমে শ্যামলী খাতুনকে পথশিশু হিসেবে চিহ্নিত করে প্রকল্পে উকারভেঅগী হিসেবে নেওয়া হয়। পথশিশু শ্যামলী খাতুন ২০১৩ সালে ৩য় শ্রেণিতে অধ্যয়নরত ছিল।
সে মহিষবাথান সরকারী কলোনী প্রাইমারি স্কুলে পড়াশোনা করত। কিন্তু বেতন না লাগলেও খাতা-কলম, স্কুল পোশাক, স্কুল ব্যাগের অভাবে সে স্কুলে যেতে ভয় পেত এবং স্কুলে গেলৌ পিছনের বেঞ্চে বসে থাকত। তার বাবা পরিবারের কোন দায়িত্ব পালন করত না। তার বাবাকে নিয়ে পরিবারে দিন দিন সমস্যা বেড়ে যাচ্ছিল। ২০১৩ সালে কারিতাস লাইফ প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হলে শ্যামলীর মা স্বাস্থ্য সেশন এবং বিভিন্ন সচেতনতামূলক সেশনে অংশগ্রহণ করে জানতে পারে যে, লাইফ প্রকল্প মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের নিরাময়ের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করে। তাই সুলেখা বেগম স্বামীকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য লাইফ প্রকল্পে আবেদন করে। ফলে ২০১৫ সালে তার আবেদনের ভিত্তিতে তার স্বামীকে মাদক গ্রহণ থেকে মুক্তিলাভের জন্য বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন এন্ড এসিস্টেন্ট সেন্টার ফর এডিক্টস (বারাকা) সেন্টার, সাভার-ঢাকায় পাঠানো হয়।
মজিবুর রহমান বারাকা মাদকাসক্ত পূনর্বাসন কেন্দ্র, সাভার- ঢাকা থেকে ৪ মাস অবস্থান করে সুস্থ হয়ে ফিরে আসে। সে চিকিসা গ্রহণের পর প্রায় এক বছর সুস্থ ছিল। সে ভালোই কাজ কর্ম শুরু করেছিল। সে রিক্সা চালিয়ে পরিবারে স্বচ্ছলতা আনয়নে ভুমিকা রাখছিল। কিন্তু ১ বছর সুস্থ থাকার পর মোঃ মজিবর পুনরায় মাদকাসক্তিতে জড়িয়ে পড়ে। কোন কাজ কর্ম না করায় ও পরিবারে কো অর্থ সহায়তা না করায় পরিবারে আবার অশান্তি শুরু হয়। সুলেখা বেগম বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন। তিনি কি উপায়ে সন্তানদের মানুষ করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। কারণ সন্তানেরা এখন উঁচু ক্লাশে উত্তীর্ণ হয়েছে। তাদের স্কুলে লেখাপড়ার খরচও বেড়ে চলেছে। কারণ তার একার পরিশ্রমে সব দিক সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন কিন্তু মনোবল হারাননি। তিনি তার স্বামীর সহযোগিতার হাতের আশা সম্পূর্ণরুপে ছেড়ে দেন।
তিনি চেয়েছিলেন যত কষ্টই হোক না কেন তার সন্তানদের তিনি লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করবেন। শ্যামলী খাতুন লাইফ প্রকল্পের তালিকাভুক্ত পথশিশু হওয়ায় তার পরিবারের অবস্থা বিবেচনা করে শিশুটিকে প্রকল্প হতে বিভিন্ন সহায়তা (স্কুলের বেতন-১,২০০, স্কুল পোশাক-৮০০/-, স্কুল ব্যাগ-৩০০/-, খাতা কলম- ৫০০/-, প্রাইভেট-২০০০/-, চিকিৎসা-২০০০/-, পুষ্টিকর খাবার বাবদ ৫০০/-) টাকা আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয় ৮ বছরে। এছাড়াও শিশুটিকে প্রকল্পের বিভিন্ন সচেতনতামূলক সেশনে অংশগ্রহণ করানো হয়। শিশুটি সেখান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে থাকে; যদিও তার পরিবারে এখনও অভাব-অনটন রয়েছে।
দু’বছর আগে শ্যামলীর পরিস্থিতি এমনও হয়েছিল সে লেখাপড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হওয়ার মতো। তাছাড়াও তার সমবয়সী ও তার বয়সের নিচে অনেকে বিয়ে হয়ে সংসার করছে। ফলে পাড়া প্রতিবেশী অনেকে নানা মন্তব্য করত যে, এত অভাবের সংসারে লেখাপড়া শিখিয়ে কি হবে? তার মেয়েকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে পরামর্শ দেয়। তাছাড়া বয়স বেড়ে গেলে তাকে আর কেউ বিয়ে করবে না। সকল মন্তব্য উপেক্ষা করে শ্যামলী ও তার মা তাদের সিদ্ধান্তে অটুট ছিল। তার অদম্য ইচ্ছা শক্তির কারণে নানা চরাই উতরাই পার হয়ে সে ৩য় শ্রেণি হতে প্রাইমারী গন্ডি পেরিয়ে বর্তমানে রাজশাহী শহরের বালাজাননেসা উচ্চ বিদ্যালয়ে ১০ম শ্রেণির ছাত্রী।
শ্যামলী খাতুন ২০২১ সালে এস.এস.সি পরীক্ষায় অংশ নিবে। তার ইচ্ছা সে লেখাপড়া শিখে একজন ভাল সৎ পুলিশ অফিসার হবে। তার পরিবারের দুঃখ ঘুঁচাবে। তার মা তার অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেন, ‘কারিতাস লাইফ প্রকল্প একটি আর্শিবাদিত প্রকল্প। এই প্রকল্প আমার পরিবারের জন্য অনেক কিছু করেছে। তারা আমার মেয়ের হতাশা, নিঃসঙ্গতা দূর করেছে এবং তাদের সন্তানদের মতই যত্ন করে তার আত্মবিশ^াস বৃদ্ধি করেছে। আমার চেষ্টার পাশাপাশি তাদের সহযোগিতার জন্য আজ আমার মেয়ে এতদূর আসতে পেরেছে। তাই আমি কারিতাস লাইফ প্রকল্পের কাছে কৃতজ্ঞ।’